বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে বাম ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভ

শিক্ষক, রাজনীতিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, গবেষক ও ছাত্রনেতারা সমাবেশে বক্তৃতা দেন। বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও অংশ নেন। সমাবেশে বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলে প্রতিবাদী গান ও কবিতা আবৃত্তি।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভ
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভছবি - জি কে সাদিক

জনগণের নিরাপত্তার জন্য নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে শাসকশ্রেণির নিরাপত্তার জন্য। এর মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এই আইন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে৷ পক্ষান্তরে এই আইন দেশের দুর্বৃত্তগোষ্ঠী ও লুটেরা গোষ্ঠীর দায়মুক্তির আইনে পরিণত হয়েছে। আইনটি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো আয়োজিত ছাত্রজনতার এক সমাবেশে সমাবেশে বিশিষ্টজনেরা এমন দাবি জানিয়েছেন। শুক্রবার (৭ এপ্রিল) বিকেলে রাজধানী ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের আয়োজনে এ সমাবেশ হয়।

বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হকের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দীন খান, দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, চিকিৎসক হারুন অর রশীদ, লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীম আরাফাত প্রমুখ।

এছাড়াও শিক্ষক, রাজনীতিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, গবেষক ও ছাত্রনেতারা সমাবেশে বক্তৃতা করেন। বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও এতে অংশ নেন। সমাবেশে বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলে প্রতিবাদী গান ও কবিতা আবৃত্তি।

সমাবেশে থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, নওগাঁ জেলায় র‍্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও বিচার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সব মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়।

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। সভাপতির বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধারায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংসদ সদস্য, উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিদেশি রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের ওপর ভয়ংকর আগ্রাসনও চালায় কিংবা ক্ষতিকর বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তার বিরুদ্ধেও কথা বলা যাবে না। সুতরাং এটি নিরাপত্তা দিচ্ছে তাদের, যারা বাংলাদেশের জনগণের শত্রুপক্ষ। এটা বাংলাদেশের দুর্বৃত্তগোষ্ঠী ও লুটেরা গোষ্ঠীর জন্য এক ধরণের দায়মুক্তির আইন।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জবরদস্তিমূলক শাসনের সহায়ক। এটা দুর্বৃত্ত ও লুটেরা গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য এ ধরনের আইন করা হয়েছে। এ রকম আইন আরও আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দীন খান বলেন, আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা বলছি। নাম ডিজিটাল কিন্তু এটাও এক ধরনের পশ্চাৎগামিতা। সেই ডিজিটালের আড়ালে রয়েছে আরেক পশ্চাৎগামী আইন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, যেটা হয়েছিল ১৯২৩ সালে। একটি পত্রিকার নিবন্ধন বাতিলের জন্য আমাদের নায়ক-নায়িকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাঁড়ান। যারা তীর্থের কাকের মতো পদের দিকে, নির্বাচনের মনোনয়নের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে তানজীমউদ্দিন খান আরও বলেন, এই আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা হারানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে এই আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, এই আইন মানুষের নিরাপত্তা তো দূরের কথা, মানুষের নিরাপত্তা হরণ করছে। কথা বলার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এমনকি জীবনের স্বাধীনতাও খর্ব করছে। মুশতাক ও জেসমিন জীবন দিয়েছে। সংবাদ পরিবেশন করা গণতান্ত্রিক অধিকার। দেশের এই অবস্থায় যারা না খেয়ে আছে দিনমজুরেরা যারা কষ্টে আছে। তাদের এই কষ্টের জন্য যারা দায়ী, ব্যাংক লুটপাট করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে যারা মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে, আজকে তারাই দায়ী, নাকি খবর যারা ছেপেছে তারা দায়ী এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা বুঝতে পারি না শাসকদের কীসে মানহানি হয়। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তাদের ভুলত্রুটি, অনিয়ম, দুর্নীতির সমালোচনা করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সে অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তিনি এ আইন বাতিলের দাবি জানান।

আবু সাঈদ খান আরও বলেন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এটা মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করছে। এটি স্পষ্টতই নিবর্তনমূলক আইন৷ এটি বাতিলের দাবিতে সবাইকে রাজপথে নামতে হবে।

এই আইন পুরোপুরি বাতিলের দাবি করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ। তিনি বলেন, বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিশ্বাসী মানুষেরা শুরুতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সরকার একগুঁয়েভাবে এটি প্রণয়ন করেছে। সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জন্যও এই আইনে মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলার বাদী শাসক দলের নেতা-কর্মীরা।

লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটা অদ্ভুত আইন, যে আইনে বেশির ভাগ মামলা হয়েছে মধ্যরাতে। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে করা মামলার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘তারা চুরি-লুটপাট-নিপীড়ন করতে পারবে, সেগুলো বলা যাবে না৷ ভাতের কষ্টের কথা বলাও নাকি স্বাধীনতাবিরোধী! নিপীড়নমূলক এই আইন সংস্কার নয়, অবিলম্বে বাতিল করতে হবে৷ এই আইনের আওতায় যাঁরা জেলহাজতে কষ্ট ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে৷’

উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট আত্মপ্রকাশ করেছে। এই জোটের শরিক ছাত্র সংগঠনগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, ছাত্র ফেডারেশন (জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল), বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন এবং বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রয়েছে।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in