Bangladesh: সংবাদের শিরোনাম ও ছবির মধ্যে অসঙ্গতির জেরে ধৃত সাংবাদিক; সম্পাদকের নামে মামলা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে দ্রব্যমূল্য নিয়ে করা এক সংবাদের শিরোনাম এবং ছবির মধ্যে অসঙ্গতির জের ধরে দেশটির বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার একজন সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। শনিবার ওই সাংবাদিকের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে ঢাকার এক আদালত। ওই সাংবাদিকের নাম শামসুজ্জামান শামস।
বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) তাঁকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। শামসুজ্জামান শামসের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার তাঁর জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আবার কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১–এর জ্যেষ্ঠ জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ একথা জানিয়েছেন। এর আগে গতকাল শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে কেরানীগঞ্জ থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছিল।
এদিকে একই সংবাদ প্রকাশের জেরে গত ২৯ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, পত্রিকাটির সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস, সহযোগী ক্যামেরাম্যানসহ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের নামে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আবদুল মালেক নামে এক আইনজীবী। পরে ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
অভিযোগ, এর আগে ২৮ মার্চ শেষ রাতে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে সাভারে তাঁর বাসা থেকে সিআইডির পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিআইডির পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা সাধারণ পোশাকে ছিলেন। যদিও স্থানীয় পুলিশ ও সিআইডির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
তবে ২৯ মার্চ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শামসুজ্জামানকে আটকের বিষয়ে নিশ্চিত করেন।
দৈনিক প্রথম আলোর ভাষ্য অনুযায়ী আটক করার সময় ওই বাড়ির মালিককে ডাকেন সিআইডি পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা। তাঁরা বাড়ির মালিককে বলেন, শামসুজ্জামানের করা একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সে সময় সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের আমবাগান এলাকায় শামসুজ্জামানের বাসায় যান ১৪ থেকে ১৫ জন। নিজেদের সিআইডির সদস্য পরিচয়ে শামসুজ্জামানের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তাঁর ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুটি মুঠোফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যান। পরে শামসুজ্জামানকে নিয়ে যান তাঁরা।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর তেজগাঁও ও রমনা থানায় দুটি মামলা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি আরো জানান, ‘এখন পর্যন্ত দু-তিনটির খবর জানি, আরও মামলা হচ্ছে, আমরা শুনছি।’
এদিকে বাড়ি থেকে আটক করার পর ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় পর ঢাকার সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে রমনা থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে আনা হয়। ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনা হয় শামসুজ্জামানকে। সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তাঁর আইনজীবী প্রশান্ত কর্মকার।
আটক করার ২০ ঘণ্টার বেশি পর গত ২৯ মার্চ বুধবার রাতে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এ মামলার প্রধান আসামি। সেই মামলাতেই শামসুজ্জামানকে আদালতে আনা হয়।
বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে অপরাধ মনে করায় প্রথম আলোর সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। এই মামলায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহার হয়নি। এই মামলা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা নেই।
বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছেন, প্রথম আলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে যে মামলা হয়েছে, তাতে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। আইন মেনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। নিউজ তুলে নিলেও প্রথম আলো যে অপরাধ করেছে, তা আদালতে প্রমাণ হবে। অনলাইন মিডিয়ার নিউজ নিয়ে প্রেস কাউন্সিলের বিচারের ক্ষমতা নেই। তাদের আইনে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেই। এই কাউন্সিলের শুধু তিরস্কারের ক্ষমতা আছে। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।
সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনায় দৈনিক প্রথম আলো ও ঢাকা ট্রিবিউন সহ বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সাম্প্রতিক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের (এমএফসি) ১২ সদস্য। ৩০ মার্চ এক বিবৃতিতে এমএফসি এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এমএফসির সদস্য হিসেবে এ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হচ্ছে - অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জোটটির সদস্য দেশগুলোর ঢাকা মিশন। বাংলাদেশে ইইউ ডেলিগেশনের পক্ষ থেকে দেয়া এক টুইট বার্তায় বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশ হিসেবে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপরিহার্য সুরক্ষার আলোকে কোনো দেশে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংগঠনটি বলেছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। ২৯ মার্চ সিপিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
গভীর রাতে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে তার বাসা থেকে তুলে নেয়া ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সাংবাদিক শামসের নিঃশর্ত মুক্তি ও অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটি মনে করে, এ ঘটনা একজন সাংবাদিক, দেশের একজন নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। পাশাপাশি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনে শায়েস্তা করার ভয়ঙ্কর উদাহরণও তৈরি করেছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়েছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, বিজেসি।
এছাড়াও এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি), সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ, এডিটরস গিল্ডসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন।
এদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, এসব প্রতিবাদ ও বিবৃতিতে দেশের ভাবমূর্তিতে কোনো আঁচড় পড়বে না। প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব কিছু চ্যালঞ্জে আছে। সেগুলো নিজস্ব উপায়েই সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে গণমাধ্যমসহ সব পক্ষকেই সতর্ক থাকতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যত দিন থাকবে, তত দিন এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বাক্স্বাধীনতার পরিস্থিতিও থাকবে না। কারণ, এই আইনে মধ্যযুগীয় বিচারব্যবস্থার একটা প্রতিফলন আছে। এ কারণেই উদ্ভট ও অযৌক্তিক এই আইন বাতিল করা উচিত।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন