জঙ্গলমহলে এখন চর্চার অন্যতম বিষয় জনগোষ্ঠীগুলোর জাতিসত্তা। নতুন নতুন করে জাতিসত্তার আন্দোলন সৃষ্টি হচ্ছে আন্দোলন বাড়ছে। আর এর নেপথ্যে একমাত্র কারণ জঙ্গলমহলে মানুষের সংকট বেড়েছে। কে আদি, কে বুনিয়াদি, কে মূলনিবাসী বিতর্কে মূল সমস্যার চর্চা ধামাচাপা পড়ছে। ভোট ব্যাংকের কথা মাথায় রেখে কিছু বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর ধর্মস্থানে সরকারি অর্থ বরাদ্দ করে ধর্মচাষে উৎসাহ যোগাচ্ছে। জঙ্গলমহলের মানুষ তার ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরেই কোন সরকারি বদান্যতা ছাড়াই। কিন্তু এক্ষেত্রে যখন থেকে সরকারিভাবে নাক গলানো শুরু হয়েছে, তখন থেকেই জনগোষ্ঠীরগুলির ঐক্যে চিড় ধরতে শুরু করেছে। সূক্ষ্ম মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বৈরিতা বেড়েছে। নিজেদের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ, আক্রোশ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনগোষ্ঠীরগুলির সামাজিক সংগঠনে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। অতীতে জঙ্গলমহল এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল বলে জানা নেই।
জঙ্গলমহলের মানুষের রক্তের সম্পর্ক নিয়ে গৌত্রের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধতা খুবই দৃঢ় ছিল। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে জোটবদ্ধ হওয়া কিম্বা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করা জঙ্গলমহলে কম্মিনকালেও ছিল না। ধর্মকে জঙ্গলমহলের মানুষ এতকাল বিশেষ গুরুত্বের মধ্যেই রাখেনি। তাই জাতিসত্ত্বার আন্দোলনে, সামাজিক আন্দোলনে যখন ধর্ম একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন জঙ্গলমহলের অধিবাসীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা নতুন করে ধর্মের শিকড় খুঁজতে বসে। জঙ্গলমহলের মানুষের ধর্ম 'সারি' নাকি 'সারনা' সেই বিতর্কের মিমাংশা জটিল হয়ে পড়ে। এই জটিলতার পিছনেও রয়েছে যুগ যুগ ধরে নানা শাসকের উদ্যোগে জঙ্গলমহলের মানুষের সরল মস্তিষ্কে ধর্মচাষের প্রভাব। জঙ্গলমহলে ভাষা সংস্কৃতি ধর্মের মধ্যেই মানুষকে আটকে রেখে বর্তমান শাসক শ্রেণী তার ফসল নিজের খামারে তুলে নিচ্ছে। আর এই সুযোগেই জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের আদিবাসীত্বকেই অস্বীকার করার কাজ চলছে সুচারুভাবে। তাই জঙ্গলমহলের আদিবাসী নিয়ে দু চার কথা এখন বলা জরুরী।
একথা নিঃসংশয়ে উল্লেখ করা যায় যে, জঙ্গলমহলে সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষের বসবাস ছিল। ভারতবর্ষের বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ MVA Sastri ২৫ /০১ /১৯৭৮ - এ Report Fossil Man in West Bengal -এ জানিয়েছেন- জঙ্গলমহলের কাঁসাই অধুনা কংসাবতী নদী অববাহিকায় তারাফেনি এবং ভৈরাবাঁকি নদীর সংযোগ অঞ্চলে(লছিপুর) নদীর চরের চল্লিশ ফুট নীচে ২৩ বছরের এক যুবকের চোয়ালের একটি ফসিল পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিরিখে যা দশ হাজার বছর আগেকার এবং এই ফসিল যা ভারতবর্ষে এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মানবিক নিদর্শন। এর থেকে বোঝা যায় দশ হাজার বছর আগেও এই জঙ্গলমহলে মানুষের আনাগোনা ছিল, অবস্থান ছিল। কাঁসাই-কুমারী নদীর সংযোগস্থলে কংসাবতী প্রোজেক্ট নির্মাণের উদ্দেশ্যে খননকার্য চালানোর সময় চিয়াদা, হাতিখেদা, গোড়াবাড়ি, দামোদরপুর, পরেশনাথ, ভেদুয়া, কাজলপুড়া, কামারকুলি, বড়দা, বসন্তপুর, উপরশোল, সেরেংগড় কুরকুটিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে খননকার্য করে পুরাতন প্রস্তরযুগের(প্যালিওলিথিক) হাতিয়ারের সন্ধান পাওয়া যায়। এই অনুসন্ধান ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান V. Sen এর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল। তারও বছর কয়েক আগে ১৯৫৯-৬০ সালে ডিভি কৃষ্ণস্বামীর নেতৃত্বে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের অনুসন্ধান শাখা বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে নিবিড়ভাবে কাজ চালায়। ওই সময়ও ঐ অঞ্চল থেকে বেশকিছু পুরানো প্রস্তরযুগের কোয়ার্টজাইট দিয়ে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেন। যা কলকাতার যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। তারও বহু আগে ১৮৬৭ সালে তৎকালীন জঙ্গলমহলে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভি.বল বিহারীনাথ পাহাড় সংলগ্ন গোপীনাথপুর থেকে পুরাতন প্রস্তর যুগের হাতিয়ার আবিষ্কার করেন। একথা বলা যায় জঙ্গলমহলে প্লাইস্টোসিন মানবের কোনও জীবাশ্মের অবশেষ পাওয়া যায়নি । তবে এই অঞ্চলে যে প্লাইস্টোসিন মানবের উপস্থিতি ছিল তা জানা যায় তাদের ফেলে যাওয়া পাথরের হাতিয়ারগুলি থেকে।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় যদি জঙ্গলমহলের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানরত পাহাড়ের গুহাগুলো অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। জঙ্গলমহলজুড়ে এখনও বিভিন্ন পাহাড়ের গুহার নিদর্শন রয়েছে যেগুলিতে আদিম মানুষেরা বসবাস করতো, তা মোটামুটিভাবে সিদ্ধান্তে আসা যায়। কারন ঐ আদিম মানুষের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র গুলি নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পড়েনি। মানুষের অবস্থান যখন ছিল, তখন বাসস্থানও নিঃসন্দেহে ছিল। বিভিন্ন পাহাড়ের গুহা গুলিতেই দেখা গেছে শক্ত পাথর কেটে কেটে সে গুলি বানানো। গুহাগুলি সুচারু দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলেই বোঝা যায় আদিম মানুষেরাও তাদের বাসস্থান তৈরির ক্ষেত্রে বেশ বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দিয়ে গেছে । গুহার প্রবেশ দ্বারের পরে ভিতরের কুঠুরিগুলি ক্রমশই ধাপে ধাপে উঁচু । ফলে যত ঝড়বৃষ্টির ঝাপটা যাই আসুক না কেন ভিতরে জল পৌঁছানো কিছুতেই সম্ভব নয়। খাতড়ার দুই কিলোমিটারের মধ্যে মশকপাহাড়ে এরকম তিনটি গুহা রয়েছে । দুটি গুহার ভিতর পর্যন্ত এখনও পরিষ্কারভাবে দেখা গেলেও একটি গুহা মাটি পাথরে প্রায় বুজে গিয়েছে । দেখলেই বোঝা যায় গুহাগুলি প্রাকৃতিক সৃষ্ট নয় , জীবজন্তুদের দ্বারা তৈরিও নয় । শক্ত পাথরকে কেটে কেটে বাসস্থান তৈরি করা হয়েছে পরিষ্কার বোঝা যায় । মুকুটমনিপুরের কাছাকাছি দামোদরপুর মৌজায় রয়েছে পোড়াপাহাড়। যে মৌজা থেকে অতীতে আদিম মানুষের ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গুহাটি এখন আকারে অনেক বড়। শোনা যায় পরে পরে এই গুহার ভিতর থেকে আকরিক ধাতুর অনুসন্ধান চালানোও হয়েছে। বাঘমুন্ডির অযোধ্যা পাহাড়ের গুহা নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায় সেখানেও আদিম মানুষের বাসছিল । রানিবাঁধের বামনীসিনী পাহাড়েও রয়েছে এরকম একটি গুহা । ঝাড়গ্রামের লালজল পাহাড়ের দুশো মিটার উচ্চতায় রয়েছে একটি গুহা । যেখানে গুহার মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষায় পুরা প্রস্তরায়ূধ পাওয়া গেছে যা কলকাতার যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে ঐ গুহায় জীবজন্তুদের বাস। বলরামপুর , ঝালদা'র পাহাড়গুলিকেও সুচারুদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করা হলে অনুমান করা যায় এমন অনেক গুহাই রয়েছে । কিন্তু যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির ছবি
মাটি পাথর ধূয়ে বেশ কিছু গুহাই বুজে গেছে। কিম্বা উইএর ঢিবি, ইঁদুর, ছুঁচোর গর্তের মাটিতে, জীব-জন্তুদের মল ইত্যাদিতেও গুহার ভিতরের অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া কয়েকটি গুহা দেখে আন্দাজ করা যায় সেগুলি ভূকম্পনেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জঙ্গলমহলের এই গুহাগুলির সামান্য সংস্কার করে অনুসন্ধান চালালে এখনও অনেক আকর তথ্যের হদিস হাতে আসতে পারে বলেই মনে হয়। কিন্তু এদেশের সরকার অনেক কিছুই সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে এলেও জঙ্গলমহলের এই আদিম মানুষের আদি বাসস্থানগুলি সংস্কার এবং সংরক্ষণের উদ্যোগ কোনকালেই নেয়নি। এই অবহেলা চলতেই থাকলে হয়তো ধীরে ধীরে একদিন এই অমূল্য তথ্যের ভাণ্ডারগুলি হারিয়েই যাবে। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকদের এ ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে জঙ্গলমহলের গুহাগুলিতে নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন আদিম ভারতে মানুষের বসবাসের অন্যতম অঞ্চল ছিল এই জঙ্গলমহল। একথাও বলা যায় সমতলে মানুষের বসবাস বহুযুগ পরে। মানুষের ঐক্য বিনষ্টের যুগে একথা জোর দিয়েই বলা যায়- তখনকার মানুষের পরিচিতি ছিল শুধুই মানুষ। পরে পরে এসেছে গোষ্ঠী, গৌত্রএর সংস্করণে ভূঁইয়া, ভূমিজ, খাড়িয়া, কড়া, কুড়মী, সাঁওতাল প্রভৃতি পরিচিতি। সর্বশেষ আর্য-অনার্থের পরিচিতিতে হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ , খ্রীষ্টান, মুসলিম, শিখ ধর্মীয় পরিচিতিও সেখানে একেবারে নব্য মাত্র।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন