বিদ্যাসাগর চর্চার অধিকার কি বাঙালি হারিয়েছে?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরফাইল ছবি সংগৃহীত

প্রায় দেড়শো বছরের ব্যবধানে দু’বার প্রহার জুটলো তাঁর। রাস্তার ওপারে একবার, একবার এপারে। সেদিন তাঁকে আঘাত করেছিলো উন্মত্ত একদল প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ। এদিন তাঁকে আঘাত করেছে উন্মত্ত, একদল ক্ষমতালোভী, আত্মবিস্মৃত মানুষ। রাস্তার ওপারে ঠনঠনের সঙ্গে এপারে বিদ্যাসাগর কলেজের দূরত্ব কতটুকুই বা! তফাৎ এটুকুই, সেদিন আঘাত লেগেছিলো মানুষটির শরীরে। এদিনের আঘাত বাঙালির বুকে লেগেছে।

সে সময়টা হিন্দুধর্ম রক্ষার নামে বহুবিবাহ, একঘরে করে দেবার বিধান, কৌলিন্যের দোহাই দিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার, ধোপা নাপিত বন্ধ করে দেবার বিধান, মেয়েদের শাস্তির অজস্র আয়োজন ছিলো। সাম্প্রতিক সময়টাও বাঙালির খুব সংকটকাল। মেয়েরা সুরক্ষিত থাকছে না। ধর্ম নিয়ে উন্মত্ততার চূড়ান্ত। অতএব বিদ্যাসাগর এই মুহূর্তে বাঙালির সবচেয়ে চর্চিত চরিত্র হবার কথা।

ফুল মালা আর ধূপের ধোঁয়া তাঁর ছবি বা মূর্তির সামনে একেবারেই মানায় না। তিনি মাইল আবিস্কার করেছেন এমন দাবি করার ও শোনার আগে বাঙালির আত্মশুদ্ধি ও চিত্তশুদ্ধির খুব দরকার হয়ে পড়ে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মানে ঠোঁটকাটা, একটু রাগী আবার অসম্ভব সরস ও দরদী মনের একজন বাঙালি। বিদ্যাসাগর চর্চার অধিকারই তো অধিকাংশ বাঙালি হারিয়ে ফেলেছে। বাঙালির সাম্প্রতিক কথামালা দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের কুকথার চর্চা মাত্র। বোধোদয় যে আদৌ ঘটেনি সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা, বর্ণপরিচয়ের পরিবর্তে বর্ণবিভ্রমেই আজ বাঙালির পরিচয়। রঙ বদলাতে বদলাতে প্রায় গিরগিটির দশা। যুক্তিহীন, অনুকরণসর্বস্ব, আত্মবিস্মৃত, ক্ষমতার কণা প্রার্থী বাঙালিই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা সত্যি মিথ্যে, নীতি ইত্যাদির ধার ধারেনা। কর্তাভজা হয়ে নিশ্চিন্তে থাকে প্রসাদের ছিটেফোঁটার প্রত্যাশায়। বিদ্যাসাগর লিখেছেন বাঙালির কথা। চিনেছিলেন এঁদের। তিনি লিখছেনঃ

“এক বড় মানুষের কতকগুলি উমেদার ছিলেন। আহার প্রস্তুত হলে, বাবু, পার্শ্ববর্তী গৃহে গিয়ে, আহার করিতে বসিলেন; উমেদাররাও, সঙ্গে সঙ্গে তথায় গিয়া, বাবুর আহার দেখিতে লাগিলেন। নূতন পটোল উঠিয়াছে; পটোল দিয়া মাছের ঝোল করিয়াছে। বাবু দুই চারি খান পটোল খাইয়া বলিলেন, পটোল অতি জঘন্য তরকারি; ঝোলে দিয়া, ঝোলটাই খারাপ করিয়াছে। ইহা শুনিয়া, উমেদাররা বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, কি অন্যায়! আপনকার ঝোলে পটোল!! পটোল তো ভদ্রলোকের খাদ্য নয়। কিন্তু, ঝোলে যতগুলি পটোল ছিল, বাবু ক্রমে ক্রমে সকলগুলিই খাইলেন এবং বলিলেন, দেখ, পটোলটা তরকারি বড় মন্দ নয়। তখন উমেদাররা কহিলেন, পটোল তরকারির রাজা; পোড়ান, ভাজুন, শুক্তায় দেন, ডালনায় দেন, চড়চড়িতে দেন, ঝোলে দেন, ছোকায় দেন, দম করুন, কালিয়া করুন, সকলেই উপাদেয় হয়, বলিতে কি, এমন উৎকৃষ্ট তরকারি আর নাই।”

এখন নাগরিক ও গ্রামীণ বাঙালি অধিকাংশই এই উমেদারী অসুখে আক্রান্ত। বিদ্যাসাগর বড় সঠিক চিনেছিলেন এ জাতিকে। আসলে তাঁর পথচলা, তাঁর সংস্কার আন্দোলন দুর্বল করে দিতে সে সময়ে একদল মানুষের যে আগ্রহ, যে নিষ্ঠা, যেরকম ম্রিয়া হয়ে ওঠা, আজও বাঙালি তেমনই। এ ফুল ও ফুল বিহারে ব্যস্ত। মাঝখান থেকে বাঁচার পথটাই যে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, সেকথা বোঝাবে কে!

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in