উৎপল দত্ত – ফিরে দেখা

উৎপল দত্ত
উৎপল দত্তফাইল ছবি সংগৃহীত

টিনের তলোয়ার হাতে এক মহান অভিনয় শিল্পী। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “আমি শিল্পী নই।

নাট্যকার বা অন্য যে কোন আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়”। সেই বিচিত্র নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। জন্ম ২৯ শে মার্চ ১৯২৯।

একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী এবং মার্কসবাদী আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাসে অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবে তাঁর স্হান সুনির্দিষ্ট। আজ তাঁর ৮৯ তম জন্মদিন।

১৯৪৭ সালে লিটন থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে শেক্সপিয়র, বার্নাড শ, ক্লিফর্ড ওডেটস প্রমুখের নাটক ইংরেজিতে প্রযোজনা করতে ক‍রতেই দর্শক সমাজের সীমাবদ্ধতায় বিব্রত হয়ে লিটল থিয়েটার গ্রুপকে বাংলা প্রযোজনার দিকে পরিচালিত করেন। সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর দর্শক সমাজের কাছে পৌঁছবার আত্যন্তিক আগ্রহে গণনাট্য সংঘে ও রাজনৈতিক পথনাটিকার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর রচনা ও পরিচালনায় অঙ্গার, ফেরারি ফৌজ, কল্লোল প্রভৃতি নাটকে রাজনৈতিক বোধ, আঙ্গিক প্রয়োগ নাটক ও নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁকে গ্রুপ থিয়েটারের অঙ্গনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৯৭১ সালে পিপলস লিটল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে “টিনের তলোয়ার” নাটক তার একটি বড় পদক্ষেপ। উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটকের মধ্যে শ্রেনী চেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনার পরিশীলিত মিশেল তাঁকে অন্যভাবে চেনায়। এরই পাশাপাশি কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তাঁর পারদর্শিতা ছিলো প্রশ্নাতীত। গুড্ডি, গোলমাল, শৌখিন প্রভৃতিতে তাঁর কৌতুকাভিনয় আজও মানুষকে আনন্দ দেয়। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ ও আগন্তুক চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন।

পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিশ্লেষক উৎপল দত্ত বলেছেন, মানুষ সম্পর্কে তাঁর গভীরতম ধারণা তাঁর নাটকগুলোকে সফল করছে। উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁস সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণও স্মরণীয়। উনিশ শতকের বঙ্গীয় সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে মধুসূদনের বিদ্রোহকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “মধুসূদন শেষ পর্যন্ত উনিশ শতকের ঘুণধরা বিকলাঙ্গ সমাজের বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ”। যাত্রাপালার নবজাগরণ আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে তিনি গণজাগরন মূলক যাত্রা ও নাটকে তিনি নির্দেশনা দেন ও অভিনয় করেন। ১৯৯৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক ছবিতে অভিনয়ের জন্য পান বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার। হিন্দি ও বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতেও তিনি দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি, ঋত্বিক ঘটকের, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’, ‘হীরক রাজার দেশে’ প্রভৃতিতে তাঁর অভিনয় বাংলা সিনেমার সম্পদ।

তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন তারমধ্যে ‘ঝড়’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘ইনকেলাব কি বাদ’, ‘ঘুম ভাঙার গান’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। উৎপল দত্ত উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের এবং মঞ্চের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in