দুঃশাসন, আছো কেমন?

বস্ত্রহরণে দক্ষ সবাই। তা সে পশ্চিমবঙ্গ হোক বা উত্তরপ্রদেশ। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকাই যেখানে শেষ কথা সেখানে ক্ষমতা দখলে রাখতে কোনো মহিলার শরীর থেকে কাপড় টেনে খুলে দেওয়া তো সামান্য ঘটনা।
২০১৮ ও ২০২১ - পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশ - পঞ্চায়েত নির্বাচন মনোনয়ন পর্ব
২০১৮ ও ২০২১ - পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশ - পঞ্চায়েত নির্বাচন মনোনয়ন পর্বগ্রাফিক্স নিজস্ব

বস্ত্রহরণে দক্ষ সবাই। তা সে পশ্চিমবঙ্গ হোক বা উত্তরপ্রদেশ। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকাই যেখানে শেষ কথা সেখানে ক্ষমতা দখলে রাখতে কোনো মহিলার শরীর থেকে কাপড় টেনে খুলে দেওয়া তো সামান্য ঘটনা। আরও অনেক কিছুই হতে পারে। দিনের শেষে শাসক শাসকই থাকে। তার চরিত্রও একই থাকে।

‘টোটাল অ্যানার্কি গোয়িং ইন দ্য স্টেট’। ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল কলকাতা শিশির মঞ্চে রাজ্যের নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে এক বৈঠকে একথা জানিয়েছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্রকুমার সিং। যেদিন পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে হুগলীর গোঘাটে মার খেয়েছিলেন এক বাম দলের মহিলা কর্মীরা। দিনের আলোয়, প্রকাশ্যে রাস্তায় চুলের মুঠি ধরে চলেছিলো সেই মারধোর।

বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে – ওই ঘটনায় পুলিশ ছিলো নীরব দর্শক। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিলো বাঁকুড়ায়, পূর্ব বর্ধমানে। এরকম বিচ্ছিন্নভাবে না বলে বলা যায় এই ঘটনা ঘটেছিলো রাজ্য জুড়ে। বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দেওয়া আটকাতে রাজ্য জুড়ে নেমে এসেছিলো সন্ত্রাস। যার প্রেক্ষিতে ওই উক্তি করেছিলেন তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার।

এই ঘটনায় যতটা সরব হয়েছিলো সিপিআই(এম) সহ বামেরা, একইভাবে সুর চড়িয়ে গেল গেল রব তুলেছিলো বিজেপিও। কারণ তাদের কিছু প্রার্থীকেও সেবার মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি। ‘পুলিশ নিস্ক্রিয়’ এই অভিযোগে সরব হয়েছিলো বিজেপি। কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘দিনের বেলায় মহিলাদের চুলের মুঠি ধরে, শাড়ি ধরে টানাটানি করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে গুন্ডারা। মুখে কালি মাখিয়ে দিচ্ছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। তাও বিডিও অফিসের কাছে এই ঘটনা। একে অ্যানার্কি ছাড়া আর কিছু বলা যায়?’

কাট টু উত্তরপ্রদেশ। সাল ২০২১। আগামী ২০২২-এ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই বছর পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে যে নির্বাচনে অনেকটাই পিছিয়ে বিজেপি। প্রমাদ গুণেছে দলের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। পঞ্চায়েতের রাশ হাতের বাইরে চলে যাওয়ার অর্থ বিধানসভা নির্বাচনে ফল ভুগতে হবে। অতএব…

খেল দেখা গেল পঞ্চায়েত সভাপতির নির্বাচনে। ৭৫টি জেলার মধ্যে ৬৭টিতে জয়ী বিজেপি। সমাজবাদী পার্টির ৫। বিএসপি আগেই জানিয়েছিলো এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না। কার সুবিধা করে দিতে কে জানে!

রাজ্যের ৩০৫০ পঞ্চায়েত সদস্যের মধ্যে সমাজবাদী পার্টি পায় ৮৪২টি আসন। বিজেপি পায় ৬০৩টি আসন। বিএসপি পায় ৩৪২টি, কংগ্রেস ৬৯ ও অন্য ছোট দলগুলি পায় ১০৬টি আসনে জয়। ১০৮৮টি আসনে জয়ী হয় নির্দল। অথচ দেখা গেল অধিকাংশ জেলা পঞ্চায়েত সভাপতির পদ গেল বিজেপির দখলে। যে ঘটনা প্রসঙ্গে সমাজবাদী পার্টির অভিযোগ - জেলা প্রশাসন জোর করে সপা প্রার্থী ও অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা করতেই দেয়নি। শুধু তাই নয়, সপা নেতাদের হেনস্তার পাশাপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে ভুয়ো মামলাও দায়ের করা হয়েছে। মূল অভিযোগ বিজেপি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে।

এরপর আগামীকাল, অর্থাৎ ১০ জুলাই হবে ব্লক প্রমুখ নির্বাচন। যার মনোনয়ন ছিলো গতকাল। যেদিন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ এসেছে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে না দেবার। গুলি চলেছে, মারধোর হয়েছে, রাস্তা অবরোধ হয়েছে। বিরোধীদের আটকাতে যা যা করা যায় সব হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে - রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিকল্পিতভাবে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দেওয়া আটকাতে এই ধরণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

গতকাল উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে একেবারে ২০১৮-র পশ্চিমবঙ্গের স্টাইলে সমাজবাদী পার্টির এক মহিলা কর্মীকে প্রকাশ্যে শাড়ি ধরে টানাটানি করা হয়েছে। শাড়ি খুলে দেবারও অভিযোগ উঠেছে। মহিলার অভিযোগ, মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার জন‍্য মনোনয়ন কেন্দ্রে ঢোকার সময় তাঁকে আটকায় বিপক্ষের কর্মীরা। তাঁর কাছ থেকে মনোনয়ন পত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মহিলা তা দিতে অস্বীকার করায় তাঁর শাড়ি খুলে নেয় তাঁরা।

বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের মতই এখানেও অভিযোগ উঠেছে পুলিশি নিস্ক্রিয়তার। যে ঘটনা প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জানিয়েছেন, "প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী, আপনাদের কর্মীদের অভিনন্দন জানান। তাঁরা অনেক জায়গায় বোমা, গুলি, পাথর ছুঁড়েছে, অনেক ব‍্যক্তির মনোনয়ন কেড়েছে, সাংবাদিকদের মেরেছে, মহিলাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আইনব‍্যবস্থার চোখে কাপড় বাঁধা ‌রয়েছে এবং গণতন্ত্রের চরিত্রহনন করা হচ্ছে।"

২০১৮-র ৭ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা কিংবা ২০২১-এর ৮ জুলাই উত্তরপ্রদেশের ঘটনা একটা জিনিস প্রমাণ করে দিয়েছে। লঙ্কায় যে যায় সেই রাবণ হয়। যেন তেন প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তৃণমূল বিজেপি ভাইভাই। প্রভেদহীন। মুখে রামায়ণ মহাভারতের বুলি আওড়ালেও দুঃশাসন হতে কারোরই খুব একটা সময় লাগে না। ক্ষমতা বড়ো বালাই। টিকে থাকতেই হবে যে কোনো মূল্যে। মাভৈ মাভৈ…

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in