জ্যোতি বসু
জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

"কমরেড, আপনি আলোর ফ্রেমে থেকে যান কী স্পষ্টতায়"

"মানুষ, একমাত্র মানুষই ইতিহাস রচনা করে।..শেষ পর্যন্ত মানুষের জয়ই অবশ্যম্ভাবী।" প্রয়াণ দিবসে জ্যোতি বসু স্মরণে
Published on
শপথ বাক্য পাঠ করছেন জ্যোতি বসু
শপথ বাক্য পাঠ করছেন জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

‘‘বামফ্রন্ট সরকার শুধুমাত্র রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে সরকার চালাবে না।" - জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী‍‌ জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাছে আশা-আকাঙ্ক্ষার এক নতুন মাত্রা।

জ্যোতি বসু
জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

পঞ্চাশের দশকের কুখ্যাত নিবর্তনমূলক আইনের বিরোধী আন্দোলন, গোয়া মুক্তি আন্দোলন, চা-বাগান শ্রমিকদের আন্দোলন, সমস্ত পৌরসভায় সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু করার দাবিতে গণ-আন্দোলন - সব ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান অসামান্য।

জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত
জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্তছবি সংগৃহীত

১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন সংগঠিত করায় তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৫৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মহাকরণের সামনে আইন অমান্য আন্দোলন করে যাঁরা গ্রেপ্তার হন জ্যোতি বসু তাঁদের অন্যতম।

আন্দোলনে জ্যোতি বসু
আন্দোলনে জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের দাবিতে বিধানসভার ভেতরে এবং বাইরে তিনি ছিলেন সমান সক্রিয়। ষাটের দশকের ছাত্র-যুব-মহিলা, কৃষক, মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শ্রমিকদের সংগঠিত আন্দোলনের প্রতিটি পর্বেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের হাত ধরেই গড়ে ওঠে বামফ্রন্ট-এর ভিত্তি।

জ্যোতি বসু
জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

১৯৪৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত রাজ্যে তিনিই বিরোধী পক্ষের প্রধান কন্ঠ । স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬১ তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্পাদক। বিধানসভায় বিরোধী নেতা । কমরেড জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবন তাই সামগ্রিক গণআন্দোলনের বিকাশের মধ্যেই বিস্তৃত ও বিন্যস্ত।

জনসভায় জ্যোতি বসু
জনসভায় জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

একজন কমিউনিস্ট কীভাবে বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতিতে শ্রেণী রাজনীতির লক্ষ্য নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে , তা সে বিরোধী পক্ষ বা এবং সরকার পরিচালনা , যাই হোক না কেন, কমরেড জ্যোতি বসুর জীবন তাঁর এক অনন্য উদাহরণ।

জনসভায় জ্যোতি বসু
জনসভায় জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

জ্যোতি বসু সবসময়ই ইতিবাচক । কি বিরোধী, কি সরকারে, দুটো ভূমিকাতেই জ্যোতি বসু স্পষ্ট, নির্দ্বিধ । বিরোধী নেতা হিসেবে সরকারের তীব্র সমালোচক । কিন্তু নেতিবাচক, ধ্বংসাত্মক নয় । রাজনীতির লক্ষ্য যেহেতু মানুষ তাই সরকার-বিরোধিতার নামে আলোচনা বন্ধ করে শিল্পপ্রকল্প আটকে উদ্বাহু হতে হয়নি জ্যোতি বসুকে, বামপন্থীদের ।

ইয়াসের আরাফতের সঙ্গে জ্যোতি বসু
ইয়াসের আরাফতের সঙ্গে জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

তৃণমূলের টিকিটে জেতা পঞ্চায়েত প্রধানও যে ক্ষমতা ভোগ করছেন তা বামফ্রন্ট সরকারেরই দেওয়া । কংগ্রেস শাসনে তা ছিলনা । তৃণমূল রাজ্য সরকার সেই অধিকার কাড়তে উদ্যত ।

নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে জ্যোতি বসু
নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রশ্নেও দৃঢ় নীতিনিষ্ঠ অবস্থান নেওয়ার একটি মানদন্ড তৈরি করেছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু । । অ-বামপন্থী দল বা জোট পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যখন রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে ,তখন বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থান ছিল একেবারে বিপরীত মেরুতে ।

জ্যোতি বসু, বিমান বসু, বিনয় কোঙার ও শ্যামল চক্রবর্তী
জ্যোতি বসু, বিমান বসু, বিনয় কোঙার ও শ্যামল চক্রবর্তীছবি সংগৃহীত

রাজনৈতিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে নতুন করে বিনিয়োগ করেনি কেন্দ্রীয় সরকার । একদিকে জ্যোতি বসু এর বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার উপর জোর দিয়েছেন , অন্যদিকে হাতে যে সুযোগ আছে তা কাজে লাগানোর উপর জোর দিয়েছেন ।

মানুষের মাঝে জ্যোতি বসু
মানুষের মাঝে জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

"জ্যোতি বসুর সাত দশকের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন এবং আধুনিক ভারতের বিবর্তন একই গতিতে চলেছে। এই বিশেষ কারণে, তিনি সবসময়ই অনুপ্রেরণার উৎস এবং নবীন প্রজন্মের কাছে আদর্শস্থানীয়।" - সীতারাম ইয়েচুরী

জ্যোতি বসুর সঙ্গে দিয়েগো মারাদোনা
জ্যোতি বসুর সঙ্গে দিয়েগো মারাদোনাছবি সংগৃহীত

বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাকে জ্যোতিবাবু সোচ্চারে বলেছিলেন এই জঘন্য কাজ ঘটাতে পারে একমাত্র ‘‘অসভ্য ও বর্বররাই।’’ পরবর্তী সময়ে ১০বছর পর গুজরাটে প্রথম আমেদাবাদকে ঘিরে পরে অন্যান্য এলাকায় যে ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন ‘‘বাবরি মসজিদ ভাঙার পর অসভ্য বর্বরদের কার্যকলাপ বলেছিলাম। গুজরাটের ঘটনাকে কী অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এই ঘটনা পরম্পরা অবশ্যই অসভ্যতা ও বর্বরতা।’’ - বিমান বসু

জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যছবি সংগৃহীত

একটানা ২৩ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে আসেন জ্যোতি বসু, যা ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নৈতিকতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

জ্যোতি বসু
জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

২০০৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য তাঁর মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারপত্রে সই করতে গিয়ে জ্যোতি বসু লিখেছিলেন, ‘একজন কমিউনিস্ট হিসাবে, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানবজাতির সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য আমি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমি খুশি যে এখন এমনকি মৃত্যুর পরেও আমি এই সেবা করতে পারবো।’

শেষ যাত্রায় জ্যোতি বসু
শেষ যাত্রায় জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

"জ্যোতি বসু ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু, তিনি জীবিত থাকবেন মানুষের হৃদয়ে — শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর এবং কর্মচারী, যাঁদের জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গিয়েছেন, তাঁদের মননে। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সৌধকে শক্তিশালী করতে তাঁর যে মহার্ঘ অবদান, স্বাধীন ভারতে খুব কম নেতাই তা দাবি করতে পারেন।" - প্রকাশ কারাত

শেষ যাত্রায় জ্যোতি বসু
শেষ যাত্রায় জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

"ইতিহাসে এক একটা ক্ষেত্রে এমন হয় । সময় ব্যক্তিকে গড়ে পিটে নেয় । ব্যক্তি গড়ে পিটে নেয় সময়কে । প্রাক-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্ব থেকে একুশ শতকের প্রথম দশক —- রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে এতগুলি সন্ধিক্ষণের সওয়ার হওয়া ইতিহাসে বিরল । কমরেড জ্যোতি বসু সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের অন্যতম।" - অঞ্জন বেরা

শেষ যাত্রায় জ্যোতি বসু
শেষ যাত্রায় জ্যোতি বসুছবি সংগৃহীত

"এদেশের সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই করেছি, ইতিহাসের বহু বাঁক ও মোড় পেরোতে হয়েছে। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষই আমার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন। অতীতের কথা লেখা খুব কঠিন। দিন সন ঘটনা পরম্পরা মনে থাকে না। তা ছাড়া নিজের কথা এসে যাবে। যে কথা বলতে আমি দ্বিধা বোধ করি।" - জ্যোতি বসু

কমরেড জ্যোতি বসু, আপনাকে লিখছি

মেধাহীন, প্রেমহীন অপচয় লগ্নে
ঝুঁকে আছে হিসেবি সময়
যতদূর চোখে পড়ে সুগভীর ক্ষয়।
আলো নেই, থাকবে না জলও
আগামী সঞ্চয় করে রাখে তীব্র কালো বিষ
এক মানচিত্র ঠাসাঠাসি মানুষের ফুসফুসে
মারণ সিলিকোসিস।

যারা ভোরবেলা ভোট দেয় ফুলে,
বিকেলে পাতা বা বৃক্ষমূলে,
সেইসব প্রতিবেশীদের মুখ চিনি
ওরাও আমাকে খুব চেনে-
যে বাজারে রুই মাছ বা পেঁয়াজ কিনি
দরদাম করে একই বাজারে ওরাও মুখোশ কেনে
দেখি তো নিত্যদিন।
আমাদের কাল বা পরশু তাই খুব বেশি আলোহীন।

ডামাডোল উৎসবে কে মনে রাখে বলুন
ভূমি বন্টন, পঞ্চায়েত বা সুশাসন!
পেনসিল দেবেন বলে তর্জনী, মধ্যমা, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছুঁয়ে
স্বপ্নের নায়কের ভূমিকায় -
অথচ দেখুন, হৃদয় ছুঁলো না
স্লেটের অক্ষর লেখা খুব সহজেই মুছে দেওয়া যায়।

আপনাকে প্রণাম করিনি কোনোদিন
কিন্তু ইতিহাস পড়ে দেখি।
কমরেড, আপনি আলোর ফ্রেমে থেকে যা কী স্পষ্টতায়।
দৃঢ় হয় মুঠো
সাধারণ, খুব সাধারণ কিছু প্রত্যয়ী আলো
জানি, ঠিক চিহ্নিত করে দেবে অন্ধকার অতিক্রমী
স্বপ্ন সময়।

এই প্রতিবেদনের সমস্ত ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। সমস্ত লেখা 'আগুনের পরশমণি - কিংবদন্তী জননেতা জ্যোতি বসু' ব্লগ থেকে সংগৃহীত। জ্যোতি বসু স্মরণে শেষের কবিতাটি লিখেছেন রুনা চট্টোপাধ্যায়।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in