Bangladesh: করোনায় মানুষের পাশে বামপন্থী তারুণ্য

লকডাউনের ফলে বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। চরম দুর্দশায় দিনাতিপাত করছে তারা। করোনা সংক্রমণের হার অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যাওয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থায় চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর উদ্যোগে মাস্ক ও খাবার বিতরণ
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর উদ্যোগে মাস্ক ও খাবার বিতরণছবি জি কে সাদিক

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার সারাদেশে নতুন করে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ ও লকডাউন ঘোষণা করে। লকডাউনের ফলে নিম্নবিত্তের বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। চরম দুর্দশায় দিনাতিপাত করছে তারা। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণের হার অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যাওয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থায় চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালে বেডের অভাবে রোগীর জায়গা হচ্ছে না। আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেনের অভাবে চোখের সামনে প্রিয়জনের মৃত্যু হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, আক্রান্তের মাত্র ১০ শতাংশের জন্য অক্সিজেন, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে খাবার, মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ, ভ্যাক্সিনের রেজিষ্ট্রেশন, জরুরি মেডিসিন সেবা ও অক্সিজেন নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র রাজনৈতিক দল ও যুব সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকেই বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলো মানুষের মাঝে করোনা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, মাস্ক ও নিজেদের তৈরি স্যানিটাইজার বিতরণ, নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী ও ছিন্নমূল ভাসমান মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ, জরুরি মেডিসিন সেবা ও টেলি-মেডিসিন সেবা, জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সরবরাহ, সারাদেশের পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার উদ্যোগ, সাধারণ মানুষের জন্য টিকার রেজিষ্ট্রেশনসহ আরও অনেক উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া সেতু জানান, গত বছরের ৮ই মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। প্রায় ১৭ মাসে এই মহামারী অতিমারীর রূপ ধারণ করেছে। গত বছর করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর যখন বাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সংকট তৈরি হল এবং দাম বাড়িয়ে দিলো অসাধু চক্র তখন আমরা ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ১০ লাখ স্যানিটাইজার প্রস্তুত করে ছাত্র, স্বাস্থ্যকর্মী ও শ্রমজীবী মানুষের মাঝে বিতরণ করেছি। লকডাউনের সময় আমরা জনগণের জন্য খাদ্য সহায়তা, শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ সহায়তায় ব্যবস্থাও করেছি। গত এপ্রিল (২০২১) মাসে লকডাউনে আমরা শ্রমজীবী মানুষের জন্য শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালু করেছিলাম, সেই ক্যান্টিন থেকে আমরা দৈনিক গড়ে ৫০০ জন শ্রমজীবী মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে পেরেছি। এবারের লকডাউনে আমরা ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে 'শহীদ রাজু ব্রিগেড' নামে করোনা রেসপন্স টিম গঠন করেছি। শহীদ রাজু ব্রিগেডের কার্যক্রমে, ডাক্তারের পরামর্শ, জরুরি অক্সিজেন সেবা, এম্বুলেন্স সেবা, খাদ্য সহায়তা, ভ্যাক্সিন নিবন্ধন, কাউন্সিলিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে নিয়মিত। সারাদেশের অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলাতেই 'শহীদ রাজু ব্রিগেড'র মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি। এই ভাবেই আগামী দিনগুলোতে ছাত্র ইউনিয়ন মানুষের পাশে দাঁড়াবে।'

শহিদ রাজু ব্রিগেডের উদ্যোগে অক্সিজেন সরবরাহ
শহিদ রাজু ব্রিগেডের উদ্যোগে অক্সিজেন সরবরাহছবি - জি কে সাদিক

এছাড়াও সেতু জানান, করোনাকালে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দ্রুত ভ্যাক্সিনের আওতায় এনে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতেও ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলন করছে। একইভাবে করোনাকালে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি মওকুফ দাবিতে ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের উপরে ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও ছাত্র ইউনিয়ন তার কর্মসূচি চলমান রেখে। আমরা একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ও ছাত্রদের অধিকার নিয়ে যেমন সব সময় কাজ করছি একইভাবে দেশের ও মানুষের যে কোন প্রয়োজনে ছাত্র ইউনিয়ন তার ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে সদা প্রস্তুত রয়েছে।'

করোনাকালে সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। লকডাউনে যখন সারাদেশের সব কিছু বন্ধ হয়ে যায় তখন 'দিন আনে দিন খায়' এমন মানুষগুলো অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছে। এমন পরিস্থিতি 'কমিউনিটি কিচেন' নামে শ্রমজীবী ক্যান্টিন খুলে মানুষের পাশে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। এসব বিষয়ে কথা হয় সংগঠনটির সভাপতি আল-কাদেরী জয়ের সাথে।

জয় জানান, গত বছর মার্চ মাসে যখন করোনা সংক্রমণ প্রথম ধরা পরে তখন থেকেই আমরা সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ শুরু করি। আমরা মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ করি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য 'অদম্য পাঠশালা' নামে একটি অনলাইন স্কুলের ব্যবস্থা করি। সারাদেশের ৩৮টি জেলায় প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী এই স্কুলের সাথে যুক্ত হয়েছিল। বর্তমানে ১১টি জেলায় এই স্কুল কার্যক্রম চলমান রয়েছে।'

ছবি জি কে সাদিক

সম্প্রতি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর ছাত্র ফ্রন্টের কার্যক্রম সম্পর্কে জয় বলেন, গত এপ্রিলে যখন নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করা হলো তখন আমরা সারাদেশের ১৬টি জেলায় 'কমিউনিটি কিচেন' নামে শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালু করি। প্রায় দু মাস এই ক্যান্টিন চালু ছিল। এখনও কিছু জেলায় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে আমরা সারাদেশের ২০টির মতো জেলায় করোনা আক্রান্তদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ ও সাধারণ মানুষের টিকার রেজিষ্ট্রেশন কার্যক্রম চালাচ্ছি।'

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির অনত্যম একটি কারণ হচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে করোনা নিয়ে সচেতনতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাব। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সফল হয়নি। একইভাবে করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির কাজের সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ নয় বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির কাজের প্রতি জোর দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। করোনাকালে তাদের নানাবিধ কার্যক্রম নিয়ে জানান সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী আব্দুল মুত্তালিব।

মুত্তালিব জানান, করোনার শুরু থেকে ছাত্র মৈত্রী মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করে আসছে। এছাড়াও সংক্রমণ রোধের জন্য সাধারণ মানুষের মাঝে মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ করেছি। গত বছর প্রায় ১ লাখ স্যানিটাইজার বিতরণ করেছি। বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের শহীদদের নামে ব্রিগেড গঠন করে মাস্ক, জরুরি মেডিসিন ও টেলি মেডিসিন সেবা, খাদ্য সহায়তা, জরুরি অক্সিজেন ও এম্বুল্যান্স সহায়তা দেয়ার কাজ করছি। ইতোমধ্যে ২৭টি জেলায় এই কার্যক্রম শুরু করেছি। আরও কিছু জেলায় কাজ শুরু হবে।

মুত্তালিব জানান, তারা সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি ও মাস্ক পড়ার প্রতি বেশি জোর দিয়ে সারাদেশে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

বাংলাদেশ রেড ভলান্টিয়ার্স
বাংলাদেশ রেড ভলান্টিয়ার্সছবি জি কে সাদিক

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের সাধ্যমতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে দাবি নেতৃত্ববৃন্দের। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো বাদেও যুব সংগঠন ও মূল রাজনৈতিক দলগুলোও ভলেন্টিয়ার টিম গঠন করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। গত এপ্রিলে নতুন করে লকডাউন ঘোষণার সময় রোজার মাসে দৈনিক ৫০০ মানুষকে ১ বেলার খাবারের ব্যবস্থা করে বামপন্থী যুব সংগঠন বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। একইভাবে বর্তমানেও তারা বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম।

মাসুম জানান, গত এপ্রিল মাসে আমরা শ্রমজীবী ক্যান্টিন করে সাধারণ মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করেছি। ১ মাসের অধিক সময়ে আমরা দৈনিক ৫'শ থেকে ১৫'শ মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। এখনি আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহ, সহায়তা প্রার্থী পরিবারের ১ সপ্তাহের খাবার ও জরুরি মেডিসিন ও চিকিৎসা সেবা চালু রেখেছি।

অন্যদিকে রেড ভলেন্টিয়ার টিম গঠন করে জরুরি মেডিসিন, অক্সিজেন ও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা কমিটি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা কমিটির সাধারণ ড. সাজেদ আহমেদ রুবেলের সাথে আলাপ কালে তিনি জানান, করোনাকালে বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও যুব সংগঠনগুলো মানুষের পাশে তাদের সাধ্যমত দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে। তাদের এই যে মহৎ উদ্যোগ এটা প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে অক্সিজেন সরবরাহ
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে অক্সিজেন সরবরাহছবি জি কে সাদিক

রেড ভলেন্টিয়ার টিম গঠন নিয়ে ড. রুবেল বলেন, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই আমরা নানাভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছি। বর্তমানে রেড ভলেন্টিয়ার টিম গঠন করে অক্সিজেন সরবরাহ করছি। এছাড়াও আমাদের হট লাইনে ফোন করে যারা খাদ্য সহায়তা চাইছে তাদের জন্য নাম-পরিচয় গোপন রেখে ৭ দিনের খাবারের ব্যবস্থা করছি। সর্বোপরি আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারছি এই মহামারির সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি। আমাদের ছাত্র-যুবরাও তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে যতই দিন যাচ্ছে করোনা সংক্রমণের হার ততোই বাড়ছে। দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে মহামারি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউন বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। সবার একটাই প্রশ্ন এই মহামারি থেকে কবে মুক্তি মিলবে।

(লেখক একজন ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক)

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in