রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন – বোমা, বারুদের গন্ধে আজ অশান্ত

নিজস্ব চিত্র
নিজস্ব চিত্র

ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন নিয়ে কলকাতা যখন উত্তাল, তারই এক অবসরে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন আদিবাসী অধ্যুষিত শাল ছাতিমের নিবিড় ছায়ায় ঘেরা লালমাটির দেশ বীরভূমে। তারপরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ক্রমেই সাহিত্য ও শিল্প চর্চার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। পাশেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর লাভপুর।

বড় সাধ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন। যা আসলে বোলপুর। যদিও সেই শান্তিনিকেতনই আজ অশান্তির আঁতুড়ঘর। আপাতদৃষ্টিতে নিস্তরঙ্গ বোলপুরের পরতে পরতে এখন লুকিয়ে আছে অশান্তির বীজ।

পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে যে লালমাটির দেশে শোনা যেত চন্ডীদাসী সুর এখন সেখানে গুলি আর বোমার শব্দ। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কেমন যেন বদলে যাওয়া বোলপুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যেখানে বোমা বারুদের গন্ধ, গুড় জল-নকুলদানার রাজনীতি আর ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়ন’ অনেকটাই বদলে দিয়েছে কবিগুরুর স্বপ্নের বোলপুরকে। অনেক যন্ত্রণায় কবি শঙ্খ ঘোষ তাই লেখেন – ‘দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাস্তা জুড়ে খড়গ হাতে/দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন। আর নানুরের ধান্যসরা গ্রামের জবা কিস্কু, মালতী কিস্কুরা বলেন – এখন সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় লাগে। চারদিকে বোম ফাটে। আগে এরকম কোনো ভয় ছিলোনা। আমরা রাত বারোটাতেও একা একা ফিরেছি। কোনো সমস্যা হয়নি।

বোলপুর কেন্দ্র থেকে টানা সাতবারের সাংসদ ছিলেন সিপিআই(এম)-এর সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তারও আগে চারবার বোলপুর কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন শরদীশ রায়। ২০০৯ সালে এই কেন্দ্র সংরক্ষিত হয়ে যাবার পর এখানে জয়লাভ করেন সিপিআই(এম)-এর ডাঃ রামচন্দ্র ডোম। ২০১৪-র নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের অনুপম হাজরা এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন।

বিগত সাধারণ নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ৪৮.৩৩%। সিপিআই(এম)-এর রামচন্দ্র ডোম পেয়েছিলেন ৩০.২৪% ভোট। বিজেপি এবং কংগ্রেস যথাক্রমে পেয়েছিলো ১৫.১৩% এবং ৩.৫৯% ভোট। কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, আউসগ্রাম, বোলপুর, নানুর, লাভপুর, ময়ূরেশ্বর – এই সাত বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে বর্তমান বোলপুর কেন্দ্র। যার মধ্যে তিনটি কেন্দ্র কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট এবং আউসগ্রাম পূর্ব বর্ধমান জেলায় এবং বাকী চারটি কেন্দ্র বীরভূমে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফল অনুসারে একমাত্র নানুর ছাড়া বাকী ৬টিতেই তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক।

এবারে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী অসিত মাল। যিনি কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এই কেন্দ্রের গতবারের বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী অনুপম হাজরা দলবদল করে এবার যাদবপুর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী। অন্যদিকে সিপিআই(এম)-এর হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে আছেন ডাঃ রামচন্দ্র ডোম। বিজেপির হয়ে লড়াই করছেন রামপ্রসাদ দাঁ এবং কংগ্রেসের অভিজিৎ সাহা।

স্থানীয় মানুষের বক্তব্য অনুসারে শুধু বোলপুর নয়, গোটা বীরভূম জুড়েই চাপা সন্ত্রাস আছে। যদিও বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা নিজেই যেন এবার কিছুটা ব্যাকফুটে। সম্প্রতি দলের ‘৪২এ ৪২ চাই’-এর বিরুদ্ধে গিয়ে যিনি সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন – ‘৪২-এ ৪২ বললে হয়তো পলিটিক্যালি কারেক্ট হত। কিন্তু সেটা আমি বলতে পারবো না। কয়েকটা সিট এবার হয়তো বেহাত হবে।’

মঙ্গলকোটের স্থানীয় যুবক শেখ মোহব্বত জানালেন – এখানে তৃণমূলে তৃণমূলে এমন গণ্ডগোল যে এলাকার বিধায়ক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীকে এলাকায় ঢুকতে দেয়না গ্রামের মানুষ। একবার গ্রামের মেয়ে বউরা ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করেছিলো। তারপর থেকে বিধায়ক আর এদিকে আসেনি। শ্যামবাজার হাটতলাতে আজকের আগে কবে সিপিএমের মিটিং হয়েছিলো মনে পড়েনা।

কিছুতেই নাম বললেন না কুলসোনা বাসস্ট্যান্ডের এক ষ্টেশনারী দোকানের মালিক। শুধু জানালেন – মানুষের ভেতরটা যা ছিলো তাই আছে। শুধু সন্ত্রাসের জন্য ভয়ে মানুষ মুখ বুজে আছে। তবু বলছি এবার মানুষের ভয় অনেকটাই ভেঙ্গেছে।

কথা হচ্ছিলো মঙ্গলকোটের তিনবারের বিধায়ক সাধনা মল্লিকের সঙ্গে। যার বক্তব্য – মঙ্গলকোটের একটা আলাদা ঐতিহ্য আছে, ইতিহাস আছে। এই সময়ে সেগুলো সব হারিয়ে গেল। মানুষ এখন ইতিহাস ভুলে গুলি বোমা, খুনের রাজনীতিতে মেতেছে। আমাদের এলাকা এরকম ছিলো না।

প্রায় একই কথা উঠে এলো পিন্ডারী, মাথরুন, আয়মাপাড়া, চাকুলিয়া, মাধপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে। দুর্যোধন সর, শেখ ইমারুল হকদের বক্তব্য – গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এখানে কোনো ভোট হয়নি। মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। যদিও এবার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। মানুষ মুখ খুলছেন। বাইরে বেরোচ্ছেন। যদি ভোটের দিনও মানুষ এই সাহস দেখাতে পারেন তাহলে ফলাফল অন্যরকম হবে।

বোলপুর শহরের বেশিরভাগ অঞ্চলেই সব দেয়াল তৃণমূলের দখলে। দু একটা বিজেপির লেখা চোখে পড়লেও সেই অর্থে বামেদের দেওয়াল লিখন কম। ভুবনডাঙ্গা বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা অমিতাভ সেনগুপ্ত জানালেন – দেওয়াল লিখন দিয়ে এই অঞ্চলকে বিচার করবেন না। এবারের নির্বাচন অন্যরকম। এর আগে অনেকগুলো নির্বাচন দেখেছি। মানুষকে এত চুপচাপ আগে কখনো দেখিনি। কেন্দ্র বলুন বা রাজ্য – দুই শাসকের ওপর চরম বিরক্তিতে মানুষ মুখ বন্ধ করে আছে। প্রতিকারের সুযোগ খুঁজছে।

প্রতিকারের রাস্তা আবার বাতলে দিলেন নানুরের ধান্যসরা গ্রামের যুবক দীনেশ ঘোড়ুই। তাঁর স্পষ্ট জবাব – ভয়ের কী আছে। ভয় পেলে কিছুই হবে না। আমাদের কাছে সন্ত্রাস দেখিয়ে কিছু হবেনা। ধান্যসরার মোড়ে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের দুর্গাপুর সিধু কানহু লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র দেখিয়ে বললেন – এই কেন্দ্র তৈরি হয়েছিলো ১৯৯৫ সালে বামফ্রন্ট আমলে। ২০১১-এর পর এই কেন্দ্র দখল করতে চেয়েছিলো তৃণমূল। কিন্তু আমাদের গ্রামের মানুষ খোলা মাঠে রাতের পর রাত জেগে পাহারা দিয়ে, লড়াই করে এই কেন্দ্র আজও রক্ষা করছি। রাজ্য সরকার হুল উৎসব হুল উৎসব করে এত কথা বলে। অথচ যেখানে সত্যি করেই হুল উৎসব হয় সেখানে এক পয়সাও সাহায্য দেয়না। ভয় পেলে কিছুই হবে না।

ধান্যসরা-রই মালতী কিস্কু বলছিলেন – পরিবর্তন আমাদের মনে আতঙ্ক নিয়ে এসেছে। তবে সবাই যদি চায় আবার পরিবর্তন হয়ে যাবে। সঠিক সঠিক ভোট হচ্ছেনা বলেই এই অবস্থা। ঠিকমতো ভোট হলেই সব বদলে যাবে। তিনি আরও জানালেন – ধর্ম নিয়ে লড়াই করার কোনো মানে হয়না। লড়াই হওয়া উচিৎ মানুষের অধিকার নিয়ে। অধিকার রক্ষায়।

সুবল কিস্কু বললেন – এই সরকার আসার পর থেকে আমরা কোনো সুযোগ সুবিধা পাইনি। সরকার কী বলছে জানিনা। আচ্ছে দিন আমাদের জন্য নয়। ওসব বড়লোকদের জন্য।

আবার সনাতন মুরমু-র স্পষ্ট বক্তব্য - দুটো সরকারের কোনোটাই ভালো না। এখন থেকেই বিজেপি বলছে হিন্দু মুসলিম আলাদা আলাদা থাকবে। কিন্তু মানুষে মানুষে এভাবে ভাগ করে ভালো হতে পারে না। একসাথে মিলে মিশে থাকতে হবে।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in