ইভিএম কতটা নিরাপদ ও নিশ্ছিদ্র??? প্রশ্ন থেকেই যায়

ছবি প্রতীকী সংগৃহীত
ছবি প্রতীকী সংগৃহীত

কয়েক মাস আগে উত্তরপ্রদেশে পুরসভার নির্বাচন হয়েছিলো। যে নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলে ব্যালট পেপারে এবং শহরাঞ্চলে ইভিএম-এ ভোট হয়েছিলো। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর আগেই সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব জানিয়েছিলেন – যেখানে যেখানে ইভিএম-এ ভোট হবে সেখানে সেখানে বিজেপি জিতবে আর যেখানে যেখানে ব্যালটে ভোট হবে সেখানে সেখানে বিজেপি হারবে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অখিলেশ যাদবের এই ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছিলো। একইভাবে ২০১১র নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার কোনো একজন প্রার্থী আগেভাগেই জানিয়েছিলেন তিনি কত ভোটে জিতবেন এবং সেক্ষেত্রেও ফলাফল প্রকাশিত হবার পর দেখা গেছিলো সংখ্যাটা হুবহু মিলে গেছে শতক, দশক, এককের ঘর পর্যন্ত।

আপনি রাজনীতি সচেতন হোন বা না হোন, রাষ্ট্রকাঠামোর পরিচালনায় আপনার মতামতের অধিকার থাকে – এই অধিকার কোন ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসেনি, বহু লড়াই – সংগ্রামের ফল হিসাবে আপনি এই অধিকার অর্জন করেছেন। উচ্চ–নীচ, ক্ষমতাশালী–নির্বিত্ত্ব সবাই রাষ্ট্রীয় এবং আনুষঙ্গিক পরিচালনায় নিজের ভোটদানের অধিকারী। এখনও অবধি প্রচলিত গণতন্ত্রের প্রসারিত ধারণা আমাদের এই অবধি সুযোগ পাওয়ার আইনি ব্যবস্থা রেখেছে।

ভোটব্যবস্থার নিয়মিত পরিবর্তন এবং সময়োপযোগীকরণ অন্যান্য সামাজিক প্রক্রিয়ার মতই স্বাভাবিক। সেই সময়ের দাবী মেনেই একসময় ভোটযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ভারতের সাধারণ এবং বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে Electronic Voting Machine - ই ভি এম’র ব্যবহার শুরু হয়। কাগজবিহীন এই ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রে ভোটদান এবং ভোট গণনার কাজ অতীতের ব্যালট ব্যবস্থার চেয়ে অনেক দ্রুত হয়। ইলেক্ট্রনিক ব্যাবস্থাপনার ফলে আরেকটি বড় যুক্তি উঠে আসে অভ্রান্তি এবং নিরাপত্তার। ভারতের নির্বাচন কমিশন ই ভি এম’কে মান্যতা দেবার পর থেকেই দাবি করে এসেছে ই ভি এম সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং কোনভাবেই একে প্রভাবিত (হ্যাকিং অথবা অন্যান্য অবৈধ উপায়সমূহ) করা যায় না, এতে নথিবদ্ধ ভোটের হিসাব কোনভাবেই অদল-বদল করা সম্ভব নয়। যদিও সাম্প্রতিক মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে জাতিপুর কেন্দ্রের ১২৪ নম্বর বুথে সরকারি খাতা এবং ইভিএম-এর হিসেবে ভোটদানের হিসেবে ফারাক আছে ৪৫টি ভোটের। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই অভিযোগ জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে।

এদেশের জনসাধারণ দুহাত তুলে যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত এই ব্যবস্থাকে মেনে নেন – নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এই বিশ্বাস দৃঢ় করতে সবকটি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থার সাহায্যে এই ব্যবস্থার পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালান হয়। যদিও শেষ কয়েকটি বিধানসভা এবং সাধারণ নির্বাচনের পরে ই ভি এম’র বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিকস গবেষণা সংস্থার পক্ষ থেকে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠে। দাবী করা হয়েছিল যে নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার, দেখা যায় চারিদিকেই মানুষের মতামতের যথাযথ প্রতিফলনের বদলে নির্বাচনের পরে এদেশের জনগণ প্রতারণার আঁচ পাচ্ছেন বারে বারে। অসন্তোষ জমা হতে থাকে – যদিও সরকারি বয়ানে বলা হতে থাকে ই ভি এম সুরক্ষিত – প্রচলিত ব্যবস্থার ফলে ক্ষমতাশীন’র দেওয়া আশ্বাসে সন্দেহ বাড়ে বই কমে না।

২০১০ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি টেকনিক্যাল টিম তৈরি করে, যার কাজ ছিল ই ভি এম’কে আরও স্বচ্ছ এবং নিরাপদ করে তোলা। সবকটি রাজনৈতিক দলের সুপারিশ মত একটি কাগজ যুক্ত ইউনিট প্রস্তুত হয় যা ভোটারকে একটি স্লিপ ইস্যু করবে তাদের ভোটদানের সাথে সাথেই। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট ই ভি এমের সাথে এই ভি ভি প্যাট ব্যবহারের নির্দেশ দেয়।

মূল ই ভি এম কাগজবিহীন ছিল – বিস্তারিত গবেষণায় দেখা যায় দুভাবে একে হ্যাক করা যায়; একটি পদ্ধতিতে ভোটের দিন ই ভি এমে নথিবদ্ধ কোন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের হার জানা যায় ভোট শেষ হবার আগেই, আরেকটি উপায়ে দেখা যায় ই ভি এমে নথিবদ্ধ সমস্ত ভোট গননার আগে যে কোন সময় পছন্দমতো অদল-বদল করা যায়। এই দুটি উপায়ই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের (ইলেক্ট্রনিকস) কাজ জানা যে কেউই খুব সহজে প্রয়োগ করতে পারে বলে দাবী বিশেষজ্ঞদের। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরেও ভারতের নির্বাচন কমিশন সমস্ত নির্বাচনে সবকটি বুথে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেল বা ভি ভি প্যাট’র ব্যবহার এখনও করেনি। তারা জানিয়েছে ২০১৯ সাল থেকে তারা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো ভি ভি প্যাট’র ব্যবহার শুরু করতে পারবে।

ই ভি এম যে নিশ্ছিদ্র নয় এই কথা সরাসরি স্বীকার করা না হলেও এই ইলেক্ট্রনিক্স ইউনিট যে ক্ষমতাশালী – বিত্তবানদের সুবিধামত তাদের পছন্দের সরকার গড়তে যাবতীয় দুর্নীতির হাত শক্ত করার ক্ষেত্রে সহজেই ব্যবহৃত হতে পারে একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভি ভি প্যাট ব্যবহার করা আর পুরানো ব্যালট ব্যবস্থার মধ্যে মুলত কোন ফারাক নেই – আপনি নিশ্চিত হবেন আপনার ভোট কোথায় যাচ্ছে। আপনার এই নিশ্চিত হওয়ার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার।

ই ভি এম’র পক্ষে মানুষের ভোটাধিকার সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয় এই অনুধাবন ইউরোপসহ আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি বহু আগেই করেছে। যে কারণে ইভিএম চালু হবার কিছুদিন পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি এবং ভেনেজুয়েলা অস্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে ই ভি এম’র ব্যবহার বন্ধ করেছে। আধুনিক বিশ্বের দেশগুলিতে যন্ত্রের ব্যবহার সর্বাধিক – তাই তারা আমাদের তুলনায় যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও বেশি সচেতন। একদমই বিনা কারণে তাঁরা ইভিএম ছেড়ে পুনরায় ব্যালটে ফিরেছেন এরকম ভেবে নিলে বোধহয় ভুল ভাবা হবে। বরং ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত ঠিক কী কারণে প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত ওইসব দেশ ইভিএম চালু করেও বাতিল করলেন কেন?

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in