তোতাকাহিনী

গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন

আজকাল প্রায়শই দূরদর্শনের পর্দায় বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে – কখনো বাড়ির ব্যালকনিতে বাবা মা-এর উৎফুল্ল মুখ, তাঁদের স্কুলপড়ুয়া ছেলের তৈরী করা অ্যাপ কিনে নিতে বাড়ির সামনে টাকার স্যুটকেস হাতে উপস্থিত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর তাবড় তাবড় কর্তারা – আবার কখনো পদ্মশ্রী প্রাপক পরামর্শ দিচ্ছেন বাচ্চাকে কোডিং শেখানোর জন্য কোন ইন্সটিটিউশনের সহায়তা নিতে হবে।

নব্বইএর দশকে যখন ইনফরমেশন টেকনোলজির এই রমরমা বাজারের সবে সূচনা হচ্ছে, তখন স্কুলগুলিতে লোগো বলে একটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ শেখানো শুরু হল। লোগো একটি কম্প্যুটারের ভাষা যা দিয়ে খুব সহজেই কম্প্যুটারকে বিভিন্ন নির্দেশ দেওয়া যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্প্যুটার সায়েন্স পড়ানোর সুবাদে প্রতিবেশীরা জানতেন আমার সঙ্গে কম্প্যুটারের কিছু যোগাযোগ আছে। অতএব এই সময় তৃতীয় শ্রেণীতে পাঠরত একটি শিশু আমার কাছে কম্প্যুটার ক্লাসের পাঠ নিতে আসত। কম্প্যুটারের ক্লাসে তখন তাকে লোগো শেখানো হচ্ছে। বাচ্চাটি তখনো জ্যামিতির বিশেষ কোন বিদ্যা আয়ত্ত করে নি। অথচ তার কম্প্যুটার ক্লাসে তাকে যা শেখানো হত তার জন্য প্রয়োজন ছিল সমকোণ আঁকা থেকে শুরু করে আরও জটিল জ্যামিতিক নক্সা। আমার কাছে তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কি করে জ্যামিতি না শিখিয়ে বাচ্চা ছেলেটিকে বিভিন্ন কৌণিক পরিমাপ বজায় রেখে লোগোর পেনটিকে পরিচালনা করা যায় তা শেখানো।

ঠিক এইরকমই এই শতাব্দীর শুরুতে যখন CBSE বোর্ডে একটি আধুনিক কম্প্যুটার ভাষা জাভা শেখানো শুরু হল, তখন দেখা গেল জাভা মূল যে তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবিত হয়েছে তা না শিখিয়েই ভাষাটি অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে পড়ানো হচ্ছে। জাভা object-oriented ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরী একটি ভাষা, যেখানে কম্প্যুটারকে দিয়ে একটি কাজ সম্পন্ন করানোর জন্য একগুচ্ছ বস্তুর ধারণা করা হয়, সেই বস্তুগুলির বিভিন্ন বিশেষত্বকে বর্ণিত করা হয় এবং এই বস্তু অর্থাৎ object-গুলি কিভাবে নিজেদের মধ্যে এবং পারিপার্শিক অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে ব্যবহারিক ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার দ্বারা যুক্ত হবে তার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সম্যক ধারণা স্কুলে পড়াকালীন অপরিণত কিশোর বয়সে তৈরী করা কঠিন, এবং ফলে কম্প্যুটারের কার্যপদ্ধতি বুঝে ভাষাটি শেখার পরিবর্তে যা দাঁড়ায় তা হল বিষয়টি নিয়ে ভাসা ভাসা ধারণা।

উপরের এই দুটি উদাহরণ দেওয়ার কারণ হল শিক্ষার অভিমুখের যে পরিবর্তন এই ধরণের সিলেবাস বা শিক্ষাদানের পদ্ধতির দরুণ লক্ষ্য করা যায় তাকে চিহ্নিত করা। এই ধরণের পদ্ধতি মূলত ছাত্রছাত্রীদের কোন একটি বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন ছাড়াই সে বিষয়ে দক্ষতা আয়ত্ত করতে উদবুদ্ধ করে। ঠিক যেমন দূরদর্শনের বিজ্ঞাপনে একটি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরত ছাত্রকে দেখানো হচ্ছে অ্যাপ বানিয়ে সাড়া ফেলে দিতে। যে বয়সে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়গুলির জটিলতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, সে বয়সে কম্প্যুটার বা মোবাইলের অ্যাপ বানিয়ে হয়ত আনন্দ পাওয়া যেতে পারে, খ্যাতিও অর্জন করা যেতে পারে, কিন্তু প্রকৃত বুনিয়াদি শিক্ষার সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হয়ে যায় যা অতিক্রম করা যথেষ্ট কঠিন। বিশেষ করে প্রযুক্তির জগতে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে যে পরিবর্তন ঘটছে তার সঙ্গে তাল রাখতে গেলে পুনরায় দক্ষতা অর্জন করার (re-skilling) যে আবশ্যকতা দেখা যাচ্ছে, তা মূল বিষয়গুলিতে জ্ঞান অর্জন করে শিক্ষার ভিতটি মজবুত করা গেলে তবেই সম্ভব। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাবা মা-এর সামনে এক রঙ্গিন পৃথিবীর হাতছানি দিয়ে বলা হচ্ছে যে কোডিং না জানলে শিশু বা কিশোরটি জীবনের ক্ষেত্রে বিরাট পিছিয়ে পড়বে। অর্থাৎ, শিক্ষা অর্জনের জন্য মূল বিষয়গুলিকে বাদ রেখে সহায়ক বিষয়গুলির উপর অধিক জোর দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে হয়তো সাময়িকভাবে মনে হচ্ছে যে শিশু বা কিশোরটি তার আশেপাশের অন্যান্য মানুষ, বিশেষত সমবয়সীদের থেকে এগিয়ে যাবে, কিন্তু আরও কয়েক বছর পরে যদি পুনরায় অন্য কোন প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন (re-skilling) –এর প্রয়োজন হয় তখন দেখা যাবে বুনিয়াদি শিক্ষার অভাবে ছাত্রটি সে ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।

আর একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে ইংরাজী ভাষা শিক্ষা তুলে দেওয়ার পর চতুর্দিকে, বিশেষ করে বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলি গেল গেল রব তুলতে থাকে। তাদের মূল বক্তব্য একটি যুক্তির চতুর্দিকেই ঘুরপাক খেতে থাকে যে ইংরাজী ভাষা না শিখলে ভারতবর্ষের মত বহুভাষিক দেশে অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন, অতএব ইংরাজী না জানা তরুণের ভালো চাকরী না পাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। অর্থাৎ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা একটি জাতির অগ্রগতির পথ নির্দেশ করে, যেমন বিজ্ঞান, দর্শন বা অর্থনীতি, সেইগুলি গৌণ হয়ে দাঁড়ালো। এমনকী একটি ভাষা শিক্ষার মূল যে লক্ষ্য – সেই ভাষায় সাহিত্য চর্চা – তাও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল। মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো ঝরঝরে ইংরাজীতে চটপট কথা বলতে পারা। অথচ এই ঝরঝরে কথা বলতে পারার যে দক্ষতা তা কিন্তু প্রকৃত পরিবেশে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে মাত্র ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই আয়ত্ত করা সম্ভব। কিন্তু ইংরাজী সহ যে কোন ভাষা গভীরভাবে অধ্যয়ন করা, সেই ভাষাতে রচিত সাহিত্যের রসাস্বাদন করা এবং সেই ভাষার সাহিত্য রচনা করতে সক্ষমতা অর্জন করা – এই বিষয়গুলি অবহেলিত থাকল। বাজারী মাধ্যমগুলি অতি সক্রিয়ভাবে স্থুল ইংরাজী বলতে পারার স্মার্টনেস নামক দক্ষতা অর্জনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের বাতাবরণকে ক্ষুন্ন করল। ফলে বাংলা মাধ্যমের স্কুল্গুলি যেখানে অত্যন্ত যত্ন সহকারে অংক, বিজ্ঞান বা ভূগোল শেখানো হত সেইগুলি শিক্ষার বাজারে গুরুত্ব হারালো, গুরুত্ব পেতে লাগল সদ্য গজিয়ে ওঠা ঝকঝকে ইংরাজী মাধ্যম স্কুল্গুলি। নিজের ভাষায় শিক্ষা লাভ করলে সহজে যে জ্ঞান আয়ত্ত সম্ভব সেই সার্বজনীন সত্যকে অস্বীকার করা হল।

আবার আমাদের আগের আলোচনায় ফিরে আসি। দেখা যাচ্ছে গত দুই দশক ধরে স্কুলগুলি এবং বিভিন্ন বোর্ডগুলি ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি অথবা শুধুমাত্র কম্প্যুটার নাম দিয়ে একটি বিষয় নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ানো চালু করেছে। বিভিন্ন বোর্ডের সিলেবাস ঘেঁটে এটা মনে হচ্ছে যে কম্প্যুটার সায়েন্সের বিভিন্ন বিষয়গুলি নিয়ে অত্যন্ত ওপর ওপর কিছু ধারণা দেওয়া হয় এই ধরণের বিষয়গুলি পড়াতে গিয়ে। কম্প্যুটার সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে তৈরী হওয়া নিশ্চয় বাঞ্ছনীয়। কিন্তু একটি কম্প্যুটার ঠিক কি ভাবে কাজ করে, এবং তার বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা তৈরী করতে গেলে গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় যে জ্ঞান প্রয়োজন তা বিদ্যালয় স্তরে সম্পূর্ণ হতে পারে না। ফলে বিদ্যালয় স্তরে এইরকম ওপর ওপর ধারণা দেওয়ার বেশী আর এগোনো সম্ভব হয় না। কিন্তু পড়ুয়াদের সামনে এবং অভিভাবকদের সামনে এইরকম একটা ধারণা তৈরী করা হয় যে এই কম্প্যুটার বিষয়টিতে শিক্ষালাভ করলে সেই পড়ুয়া অন্যদের থেকে এগিয়ে যাবে এবং পরবর্তীকালেও অর্থাৎ স্নাতকস্তরে বেশী সুযোগ পাবে। এই কথা অবশ্যই সঠিক নয়। সুতরাং একদিকে যেমন উপযুক্ত ভিত তৈরী না করেই বিষয়টি শেখানো হয়, অন্য দিকে ভারতবর্ষের একটা বিরাট সংখ্যক স্কুলে কম্প্যুটার প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় ন্যূনতম ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনও সম্ভব হয় না অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পক্ষে।

এই বাস্তব পরিস্থিতিকে অগ্রাহ্য করেই যে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরী হয়েছে, তাতে কম্প্যুটার সায়েন্সের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বা মেশিন লার্নিঙ-এর মত বিষয়গুলিতে বারবার জোর দেওয়া হয়েছে এবং তাতে দক্ষতা অর্জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ প্রথমত যে গণিত বা পদার্থবিদ্যায় জ্ঞান অর্জন না করে যে এই ধরণের বিষয়গুলি আয়ত্ত করা সম্ভব নয়, সেই বিষয়গুলি শিক্ষানীতিতে উল্লেখিত হয় নি। সুতরাং সেই একই প্রশ্ন এসে যাচ্ছে – দক্ষতা কি জ্ঞানের পরিপূরক হবে নাকি জ্ঞান লাভ না করে দক্ষতা অর্জন সম্ভব? এইরকম জ্ঞানবিহীন দক্ষতা কি শিক্ষার পক্ষে স্বাস্থ্যকর? দ্বিতীয়ত, সরকার নিযুক্ত কমিশনের প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি হোক বা স্কুলশিক্ষার পরিচালক বোর্ডগুলি হোক বা দূরদর্শনে দেখানো ব্যবসায়িক সংস্থাই হোক – সকলেরই উদ্দেশ্য “কম্প্যুটার শিক্ষা লাভ করলেই ভালো চাকরী পাওয়া যাবে” এইরকম একটি ধারণা ভারতীয় তরুণ প্রজন্মের মনে তৈরী করা। কিন্তু বাস্তবে কি তাই ঘটবে? আগামীদিনে শুধুমাত্র কোডিং শিখে কত শতাংশ তরুণ চাকরী পাবে? আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স পড়েও কত শতাংশ তরুণ ভারতীয় সংস্থায় নিযুক্ত হতে পারবে?

পৃথিবীব্যাপী আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং অটোমেশনের যা অগ্রগতি ঘটছে তাতে আগামী দিনে বরং নিছক কম্প্যুটার প্রোগ্রামারও গুরুত্বহীন হয়ে পরবে। বর্তমানে দূরদর্শনের পর্দায় যে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে তার ব্যবসায়িক কারণ ছাড়া কোন বাস্তবিক ভিত্তিই নেই। ব্যবসায়িক সংস্থার সাথে তাল মিলিয়ে দেশের সরকার বা সরকারের তৈরী শিক্ষা কমিশন যদি একই রকম ভ্রান্ত ধারণা জনমানসে তৈরী করতে থাকে তাহলে অন্যান্য বিষয়গুলি পঠনপাঠনের গুরুত্ব থাকে না এবং জ্ঞান অর্জনের থেকে সরে এসে শিক্ষার মূল লক্ষ্য একটি বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন হয়ে ওঠে। দেশের যে শ্রমশক্তি তাকে প্রকৃতরূপে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সুদূরব্যাপী পরিকল্পনা। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এই পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটা অত্যন্ত জরুরী। অন্যদিকে সরকারী ব্যবস্থায় প্রত্যেকের শিক্ষার সুযোগ তৈরী না হলে এই পরিকল্পনা তৈরী করা এবং তার কার্যকরী রূপায়ন অসম্ভব।

একই সাথে কিভাবে জ্ঞান অর্জনের পরিপূরক হিসাবে ছাত্র ছাত্রীরা দক্ষতার চর্চা করবে সেই বিষয়েও শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা দরকার। সরকারকেও সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে পরিকল্পনা মোতাবেক চলার নির্দেশ দিতে হবে। নাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের পেটের ভিতরেও রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনীর তোতার মত কাগজ গজগজ করবে, পাখি রাও কাটবে না, ডানাও ঝটপটাবে না।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in