রাজ্যে বিজেপির রাজনীতির এই জমি চাষ করেছে তৃণমূল - নীলোৎপল বসু

পিপলস রিপোর্টারে বিশেষ সাক্ষাৎকারে সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু
নীলোৎপল বসু
নীলোৎপল বসুফাইল ছবি, নিজস্ব

প্রশ্ন - সারাদেশ কৃষক আন্দোলনে উত্তাল। এই আন্দোলন কি বৃহত্তর কোনো আন্দোলনের পথে দেশকে নিয়ে যাবে বলে মনে হয়?

উত্তর - আসলে কৃষক আন্দোলন এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা তিলে তিলে তৈরি হয়েছে। মোদী সরকার তৈরি হওয়ার পরেই যে অর্ডিন্যান্স এনেছিল জমি অধিগ্রহণের জন্য তার বিরুদ্ধেও কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তখন বিজেপি নিরঙ্কুশ ছিল না। ফলে অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এরপরে যখন ২০১৬ তে ডিমনিটাইজেশন হল ফসলের দাম পড়তে শুরু করল। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন চলাকালীন মধ্যপ্রদেশে কৃষকের উপর গুলি চলে। ২০১৭ তে তৈরি হয় সর্বভারতীয় কিষাণ সংগ্রাম কোঅর্ডিনেশন কমিটি।

২০২০ তে যে কৃষক আন্দোলন দেখছি আমরা সেটা এই দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলাফল। সরকার মহামারীর সুযোগ নিয়ে তীব্র দক্ষিণপন্থী নীতি গ্রহণ করে এই কৃষি আইন পাস করে। মূলত পাঞ্জাবে এই আন্দোলনের শুরু। সেখান থেকেই দাবি ওঠে এই কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। ক্রমে তা সর্বভারতীয় রুপ নেয়। কারণ তাঁরা উপলব্ধি করেন, এই তিনটি বিল থাকলে তাঁদের রুটিরুজি বলে কিছু থাকবে না। শুধু তাই নয়, দেশের যে রেশন ব্যবস্থা সেটাও ভেঙে পড়বে।

নিশ্চই, এই আন্দোলন একটা নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করবে। এই আন্দোলনে ছোট বড় সব ধরনের চাষীরাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করছেন। শুধু বামপন্থী কৃষক সংগঠন নয়, তার বাইরেও প্রায় ৫০০ কৃষক সংগঠন এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকার এই আন্দোলনে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছিল, যা সফল হয়নি। কৃষকদের উপর বলপ্রয়োগ করে, লাঠি চালিয়ে, জলকামান চালিয়ে, রাস্তা আটকেও বিশেষ লাভ হয়নি। সরকার নিজেই বলছে এই আইন সংশোধন ধরবে কিন্তু বাতিল করার কথা বলছে না। এখানেই বুঝতে হবে সরকারের উপর কোথাও একটা চাপ আছে।

বামপন্থীদের কৃষি সঙ্কট নিয়ে যা মূল্যায়ন, তা এই আন্দোলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিতকরণ, সহায়ক মূল্যে সরকারকে ফসল কিনতে হবে সহ অন্যান্য দাবিগুলি সঙ্গত। এই সরকার খাদ্য সুরক্ষা আইনকে কার্যকরী করতে চায় না। সরকার ভেবেছিল কৃষকদের সাথে একের পর এক নিষ্ফলা বৈঠক করে আন্দোলনের উৎসাহ কমিয়ে ফেলবে। সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। দিল্লির পাঁচটি প্রবেশদ্বারেই তাঁরা বরং তাঁরা আরও বেশি উৎসাহে অবস্থান করছেন।

এই গোটা আন্দোলন থেকে একটাই রাজনৈতিক ভাষ্য উঠে আসে। সরকারের সামগ্রিক নীতি কয়েকজন হাতে গোনা কর্পোরেটের স্বার্থে এবং কোটি কোটি শ্রমজীবীর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েই চালিত হচ্ছে।

প্রশ্ন - ২৬ শে জানুয়ারির ট্রাক্টর প্যারেডকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা ও অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে আপনার কী মতামত?

উত্তর - এইরকম ট্র্যাক্টর প্যারেড তো এর আগে কেউ দেখেনি। ২ লক্ষের উপরে ট্র্যাক্টর এবং তাতে প্রায় ১০ লক্ষের উপরে অংশগ্রহণকারী। সরকার ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করেছে। তাঁদের মধ্যে প্ররোচনাকারীদের ঢুকিয়ে বিপথগামী করার চেষ্টাও করেছে। যাতে লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা ছাড়া অন্য কোনো পতাকা তোলে এবং শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করা যায় জনমানসে। যেহেতু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যের উপর ভিত্তি করে, তাই সফল হয়নি। আমরা ইতিহাসে পড়েছি নাৎসীরা জার্মানিতে রাইখস্ট্যাগে আগুন ধরিয়ে তার দায় কমিউনিস্টদের উপর চাপিয়েছিল। কৃষক আন্দোলন ভাঙতেও সেই পন্থা নেওয়া হয়েছিল। এতে বরং কৃষক আন্দোলন আরও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার কোণঠাসা হয়ে মিডিয়ার উপরেও আক্রমণ করছে। তাঁরা স্বাধীন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনছে। একজন অনামী সাংবাদিক ভিডিওর মাধ্যমে দেখিয়েছেন কিভাবে বহিরাগত আর এস এস কর্মীদের গুটিয়ে হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন - সিএএ, এনআরসি বিষয়ে বামপন্থীরা কি আন্দোলনে থাকছে?

উত্তর - অবশ্যই বামপন্থীরা আন্দোলনে থাকছে।

প্রশ্ন - কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তো বলে দিয়েছেন আগামী ৩ মাসের মধ্যে সিএএ কার্যকরী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

উত্তর - হ্যাঁ এটা ঠিক যে সরকার আগে যেভাবে উৎসাহ দেখাচ্ছিল, এখন আর সেভাবে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। কারণ তারা বুঝে গেছে, এক্ষেত্রে আরো বেশি বিরোধিতার সম্মুখীন হতে পারে তাদের। এটা তো শুধু বামপন্থীদের ব্যাপার নয়। এর বাইরেও একটা বৃহৎ অংশের মানুষের যোগদান আছে। তাছাড়া কোনো আইন কার্যকর করতে গেলে কিছু বিধি তৈরি করতে হয়, যা সরকার করছে না। অন্যদিকে, যেহেতু সিএএ ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে লংঘন করছে, তাই সেই বিষয়ক মামলাও সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারছে না সুপ্রিম কোর্ট। তবে যে মুহূর্তে সরকার এই বিষয়টিকে সামনে আনবে বামপন্থীদের পুরানো আন্দোলন আবার শুরু হবে।

প্রশ্ন - পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে সরকার বদলের লক্ষে দলবদল চলছে, তা অভূতপূর্ব। বিশেষ করে যাঁরা তৃণমূল দলে থাকাকালীন বিভিন্ন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা বিজেপিতে গিয়ে নাম লেখাচ্ছেন। এই বদলের ভবিষ্যৎ কী?

উত্তর - এই দল বদলের ভবিষ্যত খুবই খারাপ। এই দলগুলোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই। কিন্তু আমরা বামপন্থীরা মনে করি বিজেপি অন্যান্য সমস্ত দলের থেকেই মৌলিকভাবে আলাদা। বিজেপি পরিচালিত হয় আর এস এস দ্বারা। যেহেতু আর এস এস এর কাঠামো পুরোপুরি ফ্যাসিস্ট, সেই সঙ্গে নয়া উদারবাদী কর্পোরেটপন্থী একটা নীতি নিয়ে চলে। ফলে তাদের পরাস্ত করাটা বামপন্থীদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে প্রধান বাধা হল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যে বিজেপির রাজনীতির এই জমি চাষ করেছে তৃণমূল। বিজেপির যেসব রাজ্যে সাবেকি ক্ষমতা নেই, সেখানে তারা প্রথমে একটা কংগ্রেস বিরোধী আঞ্চলিক দলকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় পৌঁছানোর জন্য। আমাদের রাজ্যের সেই দলটা হল তৃণমূল কংগ্রেস। দীর্ঘদিন বিজেপি ও তৃণমূল একসঙ্গেই থেকেছে। তৃণমূল তৈরিই হয়েছিল বিজেপির ব্যবস্থাপনায়। বাংলার রাজনৈতিক পরিকাঠামো অনুযায়ী তারা এক সময় আলাদা হয়ে গেলেও তাদের লক্ষ্যই ছিল বামপন্থীদের বিচ্ছিন্ন করা। কারণ ঐতিহাসিকভাবেই আর এস এস মনে করে বামপন্থীরা তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। মতাদর্শগতভাবে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইকে তারা কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে। যেহেতু এই মুহূর্তে রাজ্য সরকার বিরোধী মনোভাব বাড়ছে- তাই কিছু কিছু তৃণমূল নেতা বিজেপিমুখী হচ্ছে। এতে খুব একটা লাভ হবে না। সাধারণ মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন এরা এড়িয়ে যাচ্ছে। মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বিপুল পরিমানে বিনিয়োগ করে এরা উভয়ে ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে। মৌলিকভাবে এদের কোনো তফাৎ নেই।

প্রশ্ন - পশ্চিমবঙ্গে বাম কংগ্রেস জোটের ভবিষ্যৎ কতটা?

উত্তর - বাম কংগ্রেস জোট আমি ঠিক এই শব্দটি ব্যবহার করতে রাজি নই। বিজেপির ক্রমবর্ধমান যে ফ্যাসিবাদী ঝোঁক, একে রুখতে গেলে তৃণমূলকেও রুখতে হবে। তৃণমূল বিরোধী যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি আসবে, তাদেরকে এক জায়গায় করতে হবে এবং যতদিন যাচ্ছে এই বিকল্প গড়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে।

প্রশ্ন - আব্বাস সিদ্দিকীকে আপনার ধর্মনিরপেক্ষ মনে করছেন তাহলে?

উত্তর - এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কিন্তু তাঁর দলের ঘোষণাপত্র আমরা দেখেছি। সেই ঘোষণাপত্রে কতকগুলি সদর্থক কথা নিশ্চয় আছে। শুধু মুসলিম জনগোষ্ঠী নয়, পিছিয়ে পড়া দলিত আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করবে বলেও ঘোষণা করেছে।

প্রশ্ন - কিন্তু মিমের সঙ্গে তাদের একটা বোঝাপড়া চলছে ...

উত্তর - সেক্ষেত্রে কিছু করা সম্ভব নয়। মিমের ভূমিকা তো আমরা দেখেছি মহারাষ্ট্রে কিংবা বিহারে। সরাসরি বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করেনি।

প্রশ্ন - এবারে একটু বাজেট প্রসঙ্গে আসা যাক, বিপিসিএল, এল আই সি সহ বিভিন্ন লাভজনক সংস্থার বিলগ্নীকরণের কী খুব প্রয়োজন ছিল?

উত্তর - একেবারেই প্রয়োজন ছিল না। এল আই সি-র ক্ষেত্রে আরোই সমস্যা। কারণ, এলআইসির পুঁজি তো সব সরকারের নয়, সরকারের একটা অংশ আছে মাত্র। কিন্তু পুঁজির বেশিরভাগটাই তো পলিসি হোল্ডারদের। আর বিলগ্নীকরণ করেও বিশেষ লাভ নেই- যদি না চাহিদার সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্থানের যা বেহাল দশা উৎপাদিত পন্য বা পরিষেবা ক্রয় করবে কারা!! এইভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in