ধর্ষণে ক্ষমতার দাপট, সাংস্কৃতিক ও ‘রাজনৈতিক’ সম্মতি : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পর্যালোচনা

গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
গ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন

ধর্ষণ বৈশ্বিক একটি সমস্যা। তবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো মহামারি নয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্ষণ পুরো অনিয়ন্ত্রিত মহামারির রূপ ধারণ করেছে। গোটা দেশটাই ধর্ষকের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে লাগামহীন ধর্ষণকে কেবল সামাজিক অবক্ষয় কিম্বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি বললে পরিস্থিতিকে একপেশেভাবে দেখা হবে। বাংলাদেশে অধিকাংশ ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার দাপটের সম্পর্ক রয়েছে। নারীকে সাব-হিউম্যান কিম্বা গঠনগত ও অবস্থানগত দুর্বল ভাবার প্রবণতা রয়েছে। নারীর উপর সহজে দাপট দেখানো যায় এবং সেটা ‘সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত’।

অন্যদিকে ধর্ষণের বিষয়ের রাষ্ট্র-রাজনৈতিক পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সম্মতি উৎপাদনের কাজটিও চলছে খুব নিভৃতে। এছাড়াও বাংলাদেশে মহামারি আকারে ধর্ষণের পিছনে সংস্কৃতিগত পরিবর্তন এবং সংস্কৃতিগতভাবে ধর্ষণের মনস্ততত্ত্ব তৈরির কাজটিও চলমান রয়েছে। সংস্কৃতি ব্যাপকার্থে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকেও অন্তর্ভুক্ত করে। সে হিসেবে বাংলাদেশের ধর্মগতভাবেও নারীর প্রতি বৈষম্যের মানসিকতা, নারীকে নিচু করে দেখা, তাকে দমন করা, তাকে পুরুষের তুলনায় দুর্বল বলে চিহ্নিত করা, কেবল বংশ বৃদ্ধির মাধ্যম মনে করা এবং নারীকে পুরুষের জন্য ও পরিবারের জন্য সেবাদানকারী গণ্য করার প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়াও ধর্ষণের পিছনে রয়েছে নারী শিক্ষার অভাব, নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানগত বৈষম্য, নারীর কর্মের অস্বীকৃতি, নারীকে ধর্মের আবরণে আবদ্ধ রাখা এবং সেবাদাসী হিসেবে চিহ্নি করার মানসিকতা। এসবের কারণে যখন নিয়মিতই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তখন আবার বিচার হীনতার সংস্কৃতি সেটাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই কয়েকটি বিষয় সার্বিকভাবে ধর্ষণের উর্ধ্বগতির পিছনে কাজ করছে।

বাংলাদেশে আলোচিত কিছু ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কেস স্টাডির মাধ্যমে ধর্ষণের সাথে উক্ত বিষয়গুলো কীভাবে জড়িত সেটা ধরা পরবে। বাংলাদেশে যখনই কোন ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা সৃষ্টি হয় তখন সে ঘটনা থেকে কয়েকটি বিষয় সামনে আসে। প্রথমত, ধর্ষণের ঘটনার পরপরই বিরাট একটা অংশ ধর্ষিতার পোশাক নিয়ে টানাটানি শুরু করে। বা ধর্ষিতা ধর্মের নিয়ম মেনে চলতো কি না সে বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। যেমন, ২০১৫ সালে পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে হাজার হাজার মানুষের সামনে নারী যৌন নির্যাতন করা হয়।[১] ওইদিন ১৫ নারীকে বিভিন্নভাবে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বরাদ দিয়ে প্রত্যক্ষ দর্শীদের বক্তব্যে নির্যাতনকারীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পুলিশের সামনেই বিভিন্ন নারীর উপর নির্যাতন চালায়। ঘটনাটি বেশি আলোচনায় আসে টিএসসির সামনে একটি মেয়েকে বিবস্ত্র করে ফেলার ঘটনার পর। এই ঘটনার পরপরই পহেলা বৈশাখে নারীর অংশগ্রহণ, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাসের সাথে ‘পহেলা বৈশাখের ধারণার বিরোধ’ এবং নির্যাতিত নারীর পোশাক নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। দিন শেষে এই নির্যাতনের ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় পহেলা বৈশাখকে; মেয়েটির পোশাককে। মেয়েটি প্যান্ট এবং টি-শার্ট পড়া ছিলেন। এ জন্য গত কয়েক বছর থেকে পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্র-প্রচারণা এবং একে ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এই উৎসব বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা কিম্বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া নারীদের উপর সামাজিকভাবে ঘৃণার মানসিকতা উস্কে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় সেটার বিরুদ্ধেও তুলুম কুৎসা ও উগ্র-প্রচারণা চলছে।

ওই ঘটনায় বিরাট সংখ্যক মানুষ নির্যাতিত নারীর কাঁধেই দোষ চাপিয়েছে। কারণ সে নারী হয়ে কেন এমন পোশাক পরেছে। এসব কিছুর আড়ালে চাপা পরে নারী নির্যাতনের সাথে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাদের বিচার দাবির বৃহৎ আন্দোলন। একইভাবে প্রত্যেক ঘটনার পরই উক্ত জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রথমেই নারীর ধর্ম মানা না মানা কিম্বা তার পোশাক কেমন ছিল সেটা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। যার ফলে ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতারই দায় বলে সমাজের বিশাল একটা অংশের মানসিকতা। যার ফলে এই ধরণের বিশ্বাস তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে যে, কোন নারী যদি হিজাব বা বোরকা না পরে বা ধর্মের রীতি মেনে পোশাক না পরে তাহলে তাকে ধর্ষণ করলে সমস্যা নাই। বা তাকে ধর্ষণকারী অপরাধী নয়। আর এমনটাই দেখেছি। কারণ টিএসসির ঘটনায় যারা জড়িত ছিল তারা সবাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তাদের রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক দাপট। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা এককাধিপত্য প্রতিষ্ঠাকরী সংগঠন। ঢাবির টিএসটিতে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টরকে বারবার অবহিত করা হলেও তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

উপরে বর্ণিত ধর্ষণের ঘটনা থেকে কয়েকটি বিষয় ধরা পরে। প্রথমত, ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করা এবং হিজাব-নেকাব না করলে ধর্মের দৃষ্টিতে অশালীন হয় এমন পোশাক পরলে সে নারীকে কেউ নির্যাতন করতে পারে। এর জন্য নারীর পোশাক তথা নারীই দায়ি। এবং হেজাব নেকবা পরে না এমন নারীকে নির্যাতন করা যায়। এই ধরণের মানসিকতা স্পষ্ট হচ্ছে। যার ফলে নারীকে তার পোশাকের জন্য অহরহ নির্যাতন, হেনস্তার শিকার বা নারীকে ভোগে-কামের বস্তু করার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে যারা এই ঘটনাটির সাথে সংশ্লিষ্ট তারা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ক্যাম্পাসে যাদের দাপট ও দখলদারিত্ব অপ্রতিরোধ্য। যার ফলে ক্ষোদ পুলিশও তাদের বিষয়ে সহজে অ্যাকশনে যেতে পারে না। এমনটি প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে তাদের বিষয়ে ঢাবি প্রক্টরকে অবহিত করা হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। যেটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অপারগতা ও অবহেলার বিষয়টি ফুটে উঠে। টিএসসির নির্যাতনের ঘটনাটি থেকে নারী নির্যাতনের পিছনে নারীকে দায়ি করার মানসিকতা, নারীর পোশাক নিয়ে টানাটানি, নারী নির্যাতনের সাথে ধর্মের ও ক্ষমতার দাপট কতটা সম্পর্কিত সেটা স্পষ্ট ফুটে উঠে।

২০১৫ সালে এই পুরনো ঘটনার বয়ান এখানে উপস্থাপন করার কারণ হচ্ছে এই ঘটনাটি নিয়ে তখন সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবাদ হয়েছিল। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনগুলো ‘পাল্টা আঘাত’ নামে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধারা সংগঠিত হয়েছিল। ঘটনাটির পরই নারীর পোশাক নিয়ে একটা জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। তাদের কাছে নারী নির্যাতনের ঘটনা পোশাকের তুলনায় মামুলি।

এবার আমার সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সারাদেশে আলোচিত একটি ধর্ষণের ঘটনার কেইন স্টাডি করবো। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী কর্তৃক স্বামীকে বেঁধে রেখে তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সিলেটের এই ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যে তোলপাড় শুরু হয়। গত ২৫ তারিখে সিলেটে যে বর্বর ঘটনাটি ঘটেছে তার সাথে জড়িত সবাই স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মী। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ধর্ষিত তরুণী তার স্বামীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। কলেজের ফটকের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে তার স্বামী সিগারেট কিনতে যায়। ফিরে এসে দেখেন, স্ত্রীকে কয়েকজন উত্ত্যক্ত করছে। স্বামী প্রতিবাদ করলে ছাত্রলীগকর্মীরা তাকে মারধর করে এবং তাদের সম্পর্কে জানতে চায়। তখন তাঁরা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিলে পরিচয়ের সত্যতা যাচাই করতে তাঁদের দুজনকে গাড়িসহ জোর করে কলেজ ছাত্রবাসা নিয়ে যায়। কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে একেবারে শেষ প্রান্তে নেওয়ার পর স্বামীকে আটকে রেখে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নিয়ে ধর্ষণ করা তরুণীকে ধর্ষণ করে। ঘণ্টাখানেক পর স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে ধর্ষকদল এলাকা ত্যাগ করে। এই ঘটনাটি একটু মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেই এই ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার দাপটের বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এবং ঘটনা পরবর্তী সময়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য থেকে ধর্ষণের রাজনৈতিক ও ‘রাষ্ট্রনৈতিক সম্মতির’ বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

কলেজ ফটকটি সিলেট-তামাবিল সড়কের পাশেই। যেখান দিয়ে সব সময় মানুষের যাতায়াত আছে। যখন দম্পতটিকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন অবশ্যই স্থানীয় লোকজন দেখেছে কিন্তু কেউ তাদের কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করেছে বলে কোথাও আসেনি। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এমসি কলেজও গত ২৫ মার্চ থেকে বন্ধ। তাহলে বন্ধ ছাত্রাবাসে একটি কক্ষ দখলে নিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা থাকছে অথচ কলেজ প্রশাসন নির্বিকার। এমনকি বাইরে থেকে কাউকে ধরে নিয়ে সেখানে ১ ঘণ্টা ব্যাপী ধর্ষণ করা হলো সে বিষয়েও প্রশাসন কিচ্ছু জানে না।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে কলেজের সেই রুমে তারা নিয়মিত মদ ও জুয়ার আসর বসাতো। অনেক রাত অবধি চিল্লাচিল্লি, হৈ হুল্লোড় করতো। এটা স্থানীয়দের ভাষ্য। ধর্ষণের দিন যখন হৈচৈ হচ্ছিল তখন তারা প্রথমে সেটাকে নিত্য ঘটনা বলে কর্ণপাত করেনি। এসব তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট কলেজ ছাত্রাবাসের ওই রুমে ছাত্রলীগ কর্মীরা নিয়মিতই বিভিন্ন অপকর্ম করে যাচ্ছিল। অথচ কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ। তাহলে তারা কিসের ভিত্তিতে ছাত্রাবাসে অবস্থান করছে? ধর্ষণের পরপরই পুলিশ গিয়ে উক্ত রুম থেকে বিভিন্ন দেশী অস্ত্র উদ্ধার করে। এ থেকে কলেজে সন্ত্রাসবৃত্তির রাজনীতি ও ক্ষমতার দাপটের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যও সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে।

এমসি কলেজ ও টিলাগড় এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীদের দাপুটে আচরণের কথা সে এলাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারাও স্বীকার করেছেন। ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তরা এমসি কলেজ ও টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের সক্রিয় কর্মী। এরা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রণজিত সরকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এমসি কলেজ ও টিলাগড় এলাকার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রভাবের বিভিন্ন তথ্য এখন ক্রমাগত সংবাদমাধ্যমে আসবে। সে আলোচনায় না গিয়ে উপরে যে বর্ণনা সে দিকে একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি দেয়া দরকার। ২০১৪ সালের পর থেকে প্রশাসন স্বেচ্ছায় কিম্বা বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের কাছে ছাত্রাবাসটি ছেড়ে দিয়েছে। কলেজ প্রশাসন ও ছাত্রলীগের কর্মীরা দু’ই ক্ষমতার চর্চা করে স্ব-স্ব অবস্থান ভুলে গেছে। অন্যদিকে ওই অঞ্চলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সন্ত্রাসের ঘটনা স্থানীয় প্রশাসন জানতো না এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু এই ধর্ষণের আগে তাদের বিভিন্ন অপরাধের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে এখনও সংবাদমাধ্যমে কোনো কিছু প্রকাশ হয়নি। অন্যদিকে এই ঘটনার পর যে সব ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী অপরাধীদের নানা অপকর্মের কথা বলেছন তারাও এতোদিন চুপ ছিল। এই যে কলেজ প্রশাসনের দায়িত্ব অবহেলা, স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধ দমনে ব্যর্থতা এবং দলীয় নেতা কর্তৃক প্রশ্রয় দেয়া এসবই তাদেরকে দাপুটে করে তুলেছে। যার ফলে তারা কাউকে বা যে কোন ধরণে অপরাধকে থোড়াই কেয়ার করেছে। ফটকের সামনের সড়ক থেকে দম্পতিকে তুলে নিয়ে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ করতেও তারা পিছ পা হয়নি। সেই দম্পতি স্বামী-স্ত্রী সত্যিই কি না এটা যাচাই করাকে তাদের অধিকার মনে করে নিয়েছে।

এই ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সারাদেশে যখন আন্দোলন শুরু হয়েছে তখন ছাত্রলীগও আন্দোলন করেছে। এই আন্দোলনের ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, ছাত্রলীগ কোন নারীকে অপরাধী মনে করছে তাকে প্রয়োজনে ধর্ষণও করতে পারবে। তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া অন্য কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হয় তা প্রতিহত করব।’[২] এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে স্বাধীনতা বিরোধী আর কে নয় সেটার বিচার করে কী ছাত্রলীগ ধর্ষণ করবে? স্বাধীনতা বিরোধী হলে কোন নারীকে ধর্ষণ বৈধ হয়? এই ঘটনা নিয়ে সারা দেশের মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ বা ভুল স্বীকার কোনোটাই করা হয়নি। যার ফলে কাউকে ধর্ষণ করে তাকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে চালিয়ে দেয়ার মতো মনস্ততত্ত্ব ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি করছে। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালীর সুবর্ণ চরে ধানে শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে স্থানীয় আওয়ামীল নেতাদের গণধর্ষণের শিকার গৃহবধূর ঘটনা এই মনস্ততত্ত্বের জ্বলন্ত প্রমাণ। অন্যদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সারা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখেন? কোন জায়গায় ধর্ষণ নেই? এমন কোনো দেশ নেই ধর্ষণ হয় না!’[৩] এই বক্তব্য থেকে ‘ধর্ষণ হবেই এটা স্বাভাবিক বিষয়’ ধরণের মনস্ততত্ত্ব তৈরি করতেই সহায়তা করছে।

উপরে ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার দাপট, সামাজিক মনস্ততত্ত্ব ও রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক সম্মতি উৎপাদনের বিষয়গুলো ধরা পরেছে। এ পর্যায়ে আরেকটি সংক্ষিপ্ত কেইস স্টাডি থেকে ধর্ষণের সাথে সামাজিক দাপটির বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করবো। সিলেটে ছাত্রলীগ কর্মীদের দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার কয়েকদিন আগেই গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের গোলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের এক বাড়িতে রাতে দুর্বৃত্তরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে মা-বাবাকে বেঁধে রেখে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণ। পাহাড়ে আদিবাসী নারীদের উপর বাঙালী সেটেলাদের এমন নির্যাতনের ঘটনা হামেশাই ঘটে। এসব ঘটনা থেকে পাহাড়ে আদিবাসীদের উপর বাঙালী সেটেলারদের জাতিগত আধিপত্যের বিষয়টি ধরা পরে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে নারীর উপর সহিংসতার ঘটনাগুলো সিংহ ভাগের সাথে বাঙালী সেটেলারা জড়িত থাকে। এবং সামাজিক ও জাতিগত প্রভাবে ফলে নির্যাতিত নারীরা সুবিচার পায় না। এমন নির্যাতন ক্রমাগত ঘটছেই। এছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাঙালি জনগোষ্ঠী কর্তৃক আদিবাসী নারীদের নির্যাতনের ঘটনা থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘু নারীদের উপরে সংখ্যাগরিষ্ঠদের নির্যাতনের ঘটনাও সংবাদমাধ্যমে প্রায়শই আসে। ২০০১ সালে নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য সিরাজগঞ্জের বহুল আলোচিত পূর্ণিমা শীলের উপরে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক গণর্ষণের ঘটনা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সারাদেশে বছর জুড়ে বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল হয়। এগুলো মূল ধর্মীয় প্রচারণার জন্যই হয়ে থাকে। এসব ওয়াজ মাহফিলগুলোতে নারীর উপরে সংহিসতাকে উস্কে দেয়ার মতো কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশে প্রচার করা হয়। যেখানে নারীকে সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালন, পুরুষ ও পরিবারের সেবাদাসী হিসেবে উপস্থান করা হয়। স্বামীর সেবা এবং স্বামীর সব আবদান মেনে নেয়াকে নারীর জান্নাত প্রাপ্তির অন্যতম উপায় হিসেবে প্রচার করা হয়। এবং নারীকে কেবল ঘরেই কাজ করতে হবে বাইরে বের হওয়া যাবে না এই ধরণের নারী বিদ্বেষী ও বিরোধী বক্তব্য প্রকাশ্যে প্রচার করা হলেও সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার।

অন্যদিকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন ও গণ জাগরণকেও সরকার ভয় পায়। সম্প্রতি সিলেটে ঘটে যাওয় ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে মিছিল করার সময় ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশ ও প্রগতিশীল ছাত্র জোটের কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে। ছাত্র দলের মিছিলে বাধা এবং অনেকে আটকও করেছে। ধর্ষণ বিরোধী গ্রাফিতি করতে গিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি এবং শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।[৪] সরকারের ও প্রশাসনের অসহযোগিতার ফলে সারা দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে এবং নারী বিদ্বেষী উগ্র-প্রচারণার বিরুদ্ধে কাউন্টার হিসেবে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনও জোরদার হতে পারছে না।

ফলে সারাদেশে নারীর প্রতি যে সহিংসতা ও যৌন নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা তা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ধর্ষণ বিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনও গড়ে উঠছে না। বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে কয়েকটি কেইস স্টাডি থেকে যে কারণগুলো তুলে ধরা হলো সেগুলো প্রতিহতকরণ এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলা না গেলে এই বর্বরতার লাগাম টানা সহজ হবে না। সারাদেশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিম্বা যে কোনো স্থানে ধর্ষণ বন্ধের জন্য অপরাধীকে ক্ষমতার ছায়াতল ব্যবহার করতে দেয়া বন্ধ করতে হবে। কেবল ধর্ষণ বা বড় ধরণের অপরাধ করার পর সারাদেশে প্রতিবাদ শুরু হলে সেই অপরাধীকে দল থেকে বের করে দেয়া কিম্বা তাকে দলীয় কর্মী হিসেবে অস্বীকার করাতে কোনো সমাধান হবে না। বরং ছোট হোক বড় হোক যে কোন ধরণের অপরাধীকে ক্ষমতার ছায়ায় আশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে।

তথ্যসূত্র :

১. দৈনিক ভোরের কাগজ, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫ খ্রি.
২. দৈনিক সমকাল, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ খ্রি.
৩. দৈনিক যুগান্তর, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রি./
৪. দ্য ডেইল স্টার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ খ্রি.

GOOGLE NEWS-এ Telegram-এ আমাদের ফলো করুন। YouTube -এ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন।

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in